×

নদীপাড়ের সুড়ঙ্গে আসা পানি অলৌকিক ভেবে পান করছেন মানুষেরা

‘লোকে বলতো—আল্লাহর কি কুদরত, লাঠির ভিতরে শরবত। আর এখানে (জয়পুরহাট) দেখি মাটির ফেটে বরকত। কোথা থেকে, কিভাবে, কিসের পানি আসছে, তা কেউ জানে না। হুচুকের হুজুগে বাঙ্গালি, হুচুকে পড়ে সেই পানি অলৌকিক ভেবে বোতলে নিতে হুড়াহুড়ি শুরু করছে।’

কথাগুলো বলছিলেন জয়পুরহাটের ছোট যমুনা নদীর পাড়ে হঠাৎ পানি বের হওয়া দেখতে আসা আক্কাস আলী মন্ডল। প্রায় আশি বছর বয়সী আক্কাস আলীর বাড়ি জেলার সদর উপজেলার কুঠিবাড়ি এলাকায়। তিনি বলেন, ‘জানি না এই পানি পান করলে আরো কত ধরনের রোগ শরীরে আসতে পারে, তা কেউ ভাবছে না। শেষ বয়সে এসে এমন কিছু দেখতে হবে, তা কখনও ভাবিনি।’

জয়পুরহাট সদরের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে দ্বি দেশীয় নদী ছোট যমুনা। নদীর ওপর নির্মিত কুঠিবাড়ি পুরাতন সেতুর দক্ষিণ পাশে একটি পিলারের নিচে সুড়ঙ্গ বা ফাঁটল দিয়ে সম্প্রতি পানি বের হতে শুরু করে। এ দিয়ে কখনো স্বচ্ছ, আবার কখনো ময়লাযুক্ত পানি আসছে। গত কয়েকদিন ধরে এ নিয়ে ব্যাপক কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে স্থানীয়দের মধ্যে। একে ‘অলৌকিক’ ভেবে কয়েকদিন ধরে শত শত নারী-পুরুষ নদী পাড়ে এসে পানি সংগ্রহ করছেন। বিভিন্ন জটিল রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় সেই পানি পান করছেন অনেকে। দিন যত গড়াচ্ছে নদী পাড়ে লোকজনের ভিড় ততই বাড়ছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের ধারণা, এই পানি বালু চোয়ানো পানি। নদী থেকে প্রতিনিয়ত বালু উত্তোলন করে পাশেই স্তূপ করে রাখা হয়েছে। সেই বালু চুঁইয়ে পানি একটি সুরঙ্গ দিয়ে বের হচ্ছে। এদিকে চিকিৎসকেরা বলছেন, অপরিশুদ্ধ পানি পান করলে পানিবাহিত রোগ হতে পারে। বিশেষ করে ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েড ও জন্ডিসের মতো রোগাক্রান্তের ঝুঁকি আছে।

নদীপাড়ে যা ঘটছে
কুঠিবাড়ি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ছোট যমুনা নদীতে পাশাপাশি দুটি সেতু রয়েছে। পুরাতন সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় নতুন আরেকটি সেতু নির্মাণ হয়েছে। পরে পুরাতন সেতু পরিত্যক্ত ঘোষণা করলেও তা ভাঙ্গা হয়নি। এই সেতুর দক্ষিণ পাশে ছোট্ট সুড়ঙ্গ দিয়ে পানি বের হচ্ছে। সুড়ঙ্গের মুখে প্রথমে কলাগাছের ডোঙা (বাকল) লাগানো ছিল, পরে টিনের ‘টুই’ (চোঙ) লাগানো হয়েছে। সেই পথে পানি এসে নদীতে পড়ছে। বুধবার (১৪) দুপুরের দিকে সেখানে নারী, শিশু ও কিশোরদের বোতল হাতে নিয়ে পানি নিতে দেখা গেছে। চোঙ দিয়ে কখনো স্বচ্ছ, আবার বালু ও ময়লাযুক্ত পানি নদীতে পড়ছিল। তবে স্বচ্ছ পানি এলেই তারা নিচ্ছে।

সুড়ঙ্গের পেছনে তীররক্ষা বাঁধ রয়েছে। চারপাশে রয়েছে শুঙ্ক জায়গা। তাহলে পানি কোথায় থেকে আসছে, তা কেউ বলতে পারছেন না। এ নিয়েই পুরো এলাকায় কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এক সপ্তাহ ধরে একটি সুড়ঙ্গ দিয়ে পানি আসতে দেখে অবাক হন তারা। পরে স্থানীয় এক ছেলে সুড়ঙ্গের মুখে কলাগাছের ডোঙা লাগিয়ে দেয়। সেই পানি গিয়ে নদীতে পড়ছে। বিষয়টি এলাকায় জানাজানি হলে লোকজন সকাল-বিকাল নদী পাড়ে ছুটে আসছেন। তারা এই পানি ‘অলৌকিক’ ভেবে নিয়ে গিয়ে পান করছেন। নিষেধ করেও বন্ধ করা যাচ্ছে না।

অনিশ্চিত জেনেও বিশ্বাস
নদী পাড়ে গিয়ে দেখা গেছে, সুরঙ্গ দিয়ে কখনো স্বচ্ছ, আবার কখনো ময়লাযুক্ত পানি আসছে। তবুও সেই পানি নিতে লোকজন ভীড় করছেন। তবে পানির উৎস সম্পর্কে কেউ সঠিক তথ্য জানাতে পারেনি।

নদীপাড়েই সুড়ঙ্গের পানি পান করতে দেখা যায় পুরানাপৈল এলাকার হাসিনা বিবি নামে এক বৃদ্ধাকে। তিনি বলেন, ‘কয়েকদিন ধরে আমি অসুস্থ। এলাকার অনেকেই এখান থেকে পানি নিয়ে যাচ্ছে। তাই আমিও এসেছি, পানি নিয়ে পান করছি। দেখা যাক কি হয়!’ একই ধরনের কথা বলেন পানি নিতে আসা কুলসুম বেওয়া, রাবেয়া খাতুন, সিরাজুল ইসলামসহ অনেকে।

জেলার পাঁচবিবি উপজেলা থেকে এসেছিলেন জয়নুব বেগম। তিনি বলেন, ‘আগে আমার ছোট মেয়ের সবসময় জ্বর থাকত। দুদিন আগে এখান থেকে পানি নিয়ে গিয়ে পান করার পর সে একটু সুস্থ। তাই আজও (বুধবার) পানি নিতে এসেছি। দুই বোতল পানি নিয়ে বাড়িতে যাচ্ছি। বিশ্বাসে বস্তু মিলে। অনেক সময় রাস্তার পাশের দুবলাও (দুর্বা ঘাস) কাজে লাগে। যে যা বলে বলুক, অন্তত আমি বিশ্বাস করি এই সুড়ঙ্গের পানি অলৌকিক।’

ক্ষুব্ধ স্থানীয় বাসিন্দাও
পানি নিয়ে মানুষের হুলস্থুল কাণ্ডে ক্ষুব্ধ কুঠিবাড়ি এলাকার বাসিন্দা খোকন মিয়া। তিনি বলেন, ‘সেতুর পাশে মাটির ওপরে ও নিচে বালু আছে। তাই বালুর পানি মাটির ফাঁটল ধরে বেরিয়ে আসছে। এখানে অলৌকিক বলতে কি আছে? আর পানির সঙ্গে রোগবালাই দূরেরই বা কি সম্পর্ক আছে? সবকিছুর একটা লিমিট (সীমা) থাকা দরকার!’

খোকন মিয়া বলেন, ‘এখানকার পানি পান করে আজ পর্যন্ত কারো রোগ নিরাময় হয়েছে বলে এখনো শুনিনি। তারপরও প্রতিদিন অনেক লোকজন এসে বোতলে ভরে পানি নিয়ে যাচ্ছেন। এগুলো শিরক ছাড়া কিছুই না। এর আগেও দেশের বিভিন্ন স্থানে এমন ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো বেশি দিন টিকেনি। এখানেও তাই ঘটবে।’

একইভাবে জেলার সদর উপজেলার কুঠিবাড়ি এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠ বাসিন্দা আক্কাস আলী বলেন, ‘জানি না এই পানি পান করলে আরো কত ধরনের রোগ শরীরে আসতে পারে, তা কেউ ভাবছে না। শেষ বয়সে এসে এমন কিছু দেখতে হবে, তা কখনও ভাবিনি।’

ভূ-প্রাকৃতিক ঘটনা বলে সন্দেহ

চার বছর আগে (১ জানুয়ারি, ২০২১) কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলা সদরের পশ্চিম পানিমাছকুটি গ্রামে আরেকটি ঘটনাকে অলৌকিক মনে করেছিলেন স্থানীয় লোকজন। গ্রামে এক ব্যক্তিকে দাফনের জন্য কবর খননের সময় ভেতরে দেয়ালের গায়ের মাটিতে আরবি হরফের মতো কিছু চিহ্ন দেখেন লোকজন।

সেই সময় স্থানীয় আলেমরা জানান, কবরের গায়ের এক পাশে আরবি হরফে বিসমিল্লাহ, ইয়া ও শিন লেখা ছাপ এবং অপর পাশে মিম, হা ও মিম হরফের ছাপ দেখা গেছে। খবর ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উৎসুক মানুষের ঢল নামে সেখানে। পরে খবর পেয়ে স্থানীয় প্রশাসন শৃঙ্খলারক্ষায় ওই কবরে পাশে পুলিশ মোতায়েন করে।

এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে খবর প্রচার হলে ওই বছরের ১২ ও ১৩ জানুয়ারি কয়েকজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে ওই কবরের আশপাশের মাটি পরীক্ষা করতে যান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. মো. সাখাওয়াত হোসেন। তাঁরা আলোচিত সেই কবরের মাটি পরীক্ষা ও এর আশপাশের এলাকা পরিদর্শন করেন। প্রাথমিক গবেষায় ড. সাখাওয়াত নিশ্চিত হন যে, ওই কবরে সৃষ্ট ‘আরবি হরফের মতো চিহ্ন’ মূলত সাম্প্রতিক কোনো সময়ে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট মাটির একধরনের পরিবর্তন।

এদিকে জয়পুরহাটে ছোট যমুনার সেতু সংলগ্ন জায়গা পাড়ের সুরঙ্গ দিয়ে পানি বের হওয়াকে ভূ-প্রাকৃতিক কারণ বলে মনে করেন অনেকে। আগে-পরে কোনো এক সময় ভূমিকম্পের ফলে তৈরি হওয়া মাটির চাপে এমনটা হতে পারে বলে মনে করেন তারা।

কী বলছেন স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা

জয়পুরহাট ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. রাশেদ মোবারক। নদী পাড়ের সুড়ঙ্গে পানি পান তিনি বলেন, ‘এই পানি পান করলে পরিবাহিতা ডায়রিটা, কলেরা, লাটাইয়ে ও জন্ডিসের কুষ্ঠরোগাক্রান্ত হতে পারে।’ তিনি জেলা প্রশাসন বিষয়টি অবগত করেছেন।

জেলা জন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী উন্মেষ রোমান খান আনি। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অলৌকিক বলতে কিছুই নেই। এসব গুজব ছড়ানো হচ্ছে। মূলত নিচের বালুতে জমানো পানি বের হতে পারে, অথবা কোনো ফাঁটল দিয়ে নদীর পানি আসতে পারে। তারপরও বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment