×

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উচ্ছেদ অভিযান: ‘দেশের সৌন্দর্য করেন ঠিক আছে, একটা কর্মসংস্থান দেখান’

বেলা ৩টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের টিএসসি ফটকে সাধারণত এত ভিড় থাকে না। বৃষ্টির দিনে তো নয়ই। কিন্তু ১৫ মে বৃহস্পতিবার ভিড় ছিল। প্রশাসনের ভাষ্য, এ দিন উদ্যান নতুন চেহারা পাচ্ছে।

বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে চারটি বুলডোজার দিয়ে উদ্যানের অবৈধ দোকান ভাঙা হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে এই উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযানের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে এস্টেট ম্যানেজার (ভারপ্রাপ্ত) ফাতেমা বিনতে মুস্তাফা উপস্থিত ছিলেন।

আমিনুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নেতৃত্বে গণপূর্ত অধিদপ্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ থানার পুলিশ ও আনসার সদস্যরা সম্মিলিতভাবে অভিযান পরিচালনা করছি। এটি একটি জাতীয় উদ্যান। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অসংখ্য মানুষ এখানে ঘুরতে আসেন। সবাই যাতে নির্বিঘ্নে, নিরাপদে চলাফেরা করতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যেই আমাদের এই অভিযান।’

বিপাকে দোকানিরা

উদ্যানের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, চারপাশে কাঠ, টিন ও প্লাস্টিক স্তূপাকারে পড়ে আছে। এক্সক্যাভেটর দিয়ে টিএসসি সংলগ্ন নতুন ফটকের জন্য বালি আনা হচ্ছে। জায়গায় জায়গায় চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। দোকানিরা এদিক-সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ধ্বংসস্তূপ থেকে বিক্রয়যোগ্য জিনিসপত্র খুঁজে বের করছেন।

উদ্যানে দোকান চালাতেন মো. জালাল ও বিবি ফাতিমা। এই দম্পতি উদ্যানে খাবার বিক্রি করতেন। দোকান ভেঙে দেওয়ায় তাঁদের ৫০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে দাবি করেছেন। ফাতিমা বলেন, সকালে বিক্রির জন্য রান্না করা ভাত নিয়ে উদ্যানে এসে দেখেন, তাঁর দোকান ভেঙে ফেলা হচ্ছে। পরে উদ্যানের এক ছাউনিতে বসে খাবার বিক্রি করেন তিনি। কাল (শুক্রবার) থেকে কোথায় কী করবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা জানালেন তিনি। 

চিন্তিত মুখে স্ট্রিমকে বলেন, ‘২০ তারিখ (ছেলের) ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা। এহন যাইতে হোলার (ছেলে) ভাড়া দিতে হইব, তারপর খরচ দিতে হইব। এখন আরেকটা ক্লাস নাইনে পড়ে, ইগার রেজিস্ট্রেশনের খরচ দিতে হইব। কোইত্থেকে দিমু? ৫০ হাজার টিয়া (টাকা) তো ইয়ানে শেষ আইজকা। কী করুম হেই চিন্তায় আছি।’

উদ্যানের ফুচকা দোকানি দুলাল মিয়া বলেন, এই অভিযানে তাঁর অন্তত ১০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। এখন বাচ্চার মুখে কী তুলে দেবেন, জানা নেই। বললেন, ‘বাচ্চাটারে নিয়া একটা যে বিস্কুট কিইন্যা দিমু, হেডার টেকাটাও তো অহন ইনকাম করতে পারতেসি না।’

দোকানিরা জানান, অধিকাংশ দোকানই বিভিন্ন এনজিও বা সমিতি থেকে কিস্তিতে টাকা নিয়ে তৈরি। এখন কিস্তির টাকা শোধ করা নিয়ে তাঁরা চিন্তায় রয়েছেন। দোকানিদের অভিযোগ, উদ্যানের কমপক্ষে ৫০০ দোকান উচ্ছেদ করা হয়েছে।

কর্মসংস্থান নেই, চুরি-ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ার শঙ্কা

‘এখন আমাদেরকে কুনো একটা ব্যবস্থা কইরা দেউক। আমরা কীভাবে চলব, কীভাবে খাব। এখন আমাদের যে ক্ষতিটা আজকে করসে, আমরা তো বাসা ভাড়াও দিতে পারুম না, পোলাপান নিয়াও চলতে পারুম না। এমন একজন লোক যদি আইয়া বলত, হ্যাঁ ঠিক আছে। তোমাদের এইটা ব্যবস্থা কইরা দেওয়া হইব। তাইলে আমরা তার কাছে বলতাম’, বলছিলেন দুলাল মিয়া।

চার-পাঁচদিন আগে তাঁদের বলা হয়েছিল দোকানগুলো চাপিয়ে রাখতে। দোকানিদের দাবি, সে অনুযায়ী দোকান চাপিয়ে রেখেছিলেন তাঁরা। তার পরও কেন ভাঙচুর চালানো হলো, প্রশ্ন তাঁদের।

কর্মসংস্থানের দাবি জানিয়ে আরেক দোকানি মো. জালাল বলেন, ‘আপনি হকার নিষিদ্ধ করেন, দেশের সৌন্দর্য করেন, উন্নয়ন করেন, তবে একটা কর্মসংস্থান দেখান।’

এই উচ্ছেদের ফলে বেকার হয়ে যাওয়া কর্মচারীরা চুরি-ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়বেন বলে আশঙ্কা করে তিনি বলেন, ‘আজকে এই দোকানপাট ভাঙাতে অনেক হকার উচ্ছেদ হইছে। এগুলাতে হাজার হাজার পরিবার বেকার হইছে। এরা আজকে কোনোরকম খাবে, কালকে কোনোরকম খাবে, পরশুদিন থেকে চুরি করবে, ডাকাতি করবে। যে কোনো একটা পেশা সে বাইছা নেবে।’

উদ্যানের পাশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য গণপূর্ত অধিদপ্তরে আবেদন করবেন বলে জানান দোকানিরা। 

অবশ্য জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর দোকানের সংখ্যা বেড়েছে বলে দাবিও করেন দুলাল মিয়া। এই দোকানগুলো ছাত্রদের নামে অবৈধ প্রভাব বিস্তার করত বলে অভিযোগ করেন তিনি। বলেন, ‘এখানে ২০-৫০টা দোকান আছিল। ৫ আগস্টের পর থিকা এখানে হাজার হাজার দোকান দিয়ালাইছে। জিগাইলে কয়, আমরা ছাত্র। ছাত্রগো উপরে কোনো কথা কইতে পারি না। গাজীপুর থিকা আয়া দোকান লাগায়, নারায়ণগঞ্জ থিকা আয়া দোকান লাগায়- এরা ছাত্র। হ্যাগোরে কিছু কওন যায় না। অহন ছাত্ররা দেশ চালায়, ছাত্ররা সবকিছু।’

বৃহস্পতিবারের এই অভিযানের জন্য মাদক কারবারিদের দায়ী করেন দোকানিরা। সাধারণ দোকান উচ্ছেদ করা হলেও মাদক কারবারিরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে বলে অভিযোগ তাঁদের। দুলাল মিয়া বলেন, ‘ছোট ছোট পোলাপাইন গাঁজা বেচতাসে, ওডির কোন খবর নাই। আমগো হকারের উপর ঝামেলা।’

কাঠ চুরির উৎসব

বের হওয়ার পথে দেখা গেল, মো. জালাল দৌঁড়াচ্ছেন। লক্ষ্য কাঠ চোরদের ধরা। এ অভিযানের পর কিছু মানুষ রিকশা করে ধ্বংসস্তূপ থেকে কাঠ চুরি করে নিয়ে যাচ্ছেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের রমনা কালী মন্দির ফটক থেকে টিএসসি ফটক পর্যন্ত বেশ কিছু স্থানে রিকশা দাঁড় করানো। তাতে কাঠের স্তূপ। কার অনুমতিতে এ কাঠ নিচ্ছেন জিজ্ঞেস করলে উত্তর আসে, ‘বাকিরাও তো নিচ্ছে।’

বলা দরকার, গত ১৩ মে মঙ্গলবার রাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চ সংলগ্ন এলাকায় দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে মারা যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আলম সাম্য। এ ঘটনার পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের টিএসসি ফটক স্থায়ীভাবে বন্ধ থাকবে। এ ছাড়া উদ্যানে অবৈধ দোকান উচ্ছেদ, মাদক ব্যবসা বন্ধ ও পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিতে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, সিটি কর্পোরেশন, ডিএমপি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে যৌথ অভিযান পরিচালিত হবে। 

 

আরও পড়ুন: শাহরিয়ার হত্যাকাণ্ড: দিনভর উত্তাল ঢাবি ক্যাম্পাস, গ্রেপ্তার তিন, বিচার চান বাবা

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment