×

খালেদা, জুবাইদা, শামিলা: দুই প্রজন্মের একসঙ্গে দেশে ফেরা কি নতুন রাজনীতির ইঙ্গিত 

বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দুই প্রজন্মের তিন নারী একসঙ্গে দেশের মাটিতে পা রেখেছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, তাঁর দুই পুত্রবধূ জুবাইদা রহমান ও শামিলা রহমান সিঁথি গতকাল সোমবার স্থানীয় সময় ২টা ১০ মিনিটে লন্ডনে তারেক রহমানের বাসা থেকে বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওয়ানা হন। তাঁদের এই ফেরা কি দেশের রাজনীতিতে নতুন ইঙ্গিত দিচ্ছে? 

কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির দেওয়া বিশেষ রাজকীয় বিমান (অত্যাধুনিক এয়ার অ্যাম্বুলেন্স) খালেদা জিয়া ও সফরসঙ্গীদের নিয়ে দোহা বিমানবন্দর থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। গতকাল সোমবার বাংলাদেশ সময় রাত ৯টা ৩৫ মিনিটে তাঁদের বহনকারী বিমানটি হিথ্রো বিমানবন্দর ত্যাগ করে।

একসঙ্গে দুই প্রজন্মের তিন নেত্রীর দেশে ফেরাকে সামাজিক ও রাজনৈতিক এই দুই প্রেক্ষাপট থেকে ব্যাখ্যা করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক শামসুল আলম সেলিম।

তিনি বলছেন, ফ্যসিস্ট সরকারের ব্যক্তিগত আক্রোশের শিকার হয়ে বিএনপির শীর্ষ রাজনৈতিক পরিবারটির (জিয়া পরিবার) সদস্যরা লম্বা সময়জুড়ে একসঙ্গে থাকতে পারেনি। জুবাইদা রহমান অনেক আগে দেশ ছেড়েছেন। তিনি বলেন, এই তিন নারী দেশের বাইরে দেখা করলেন এবং একসঙ্গে দেশের মাটিতে পা রাখলেন, এটা বাংলাদেশের মানুষের পারিবারিক ও সামাজিক শক্তির পরিচয় বহন করে। 

অন্যদিকে এই দেশে ফেরায় বিএনপির রাজনীতিকে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। শামসুল আলম বলেন, বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীরা আরও উজ্জীবিত হবে এবং রাজনীতি আরও বেশি সক্রিয় হয়ে উঠবে। ফলে বিএনপির শক্তি বাড়বে এবং দ্রুত নির্বাচনের ব্যাপারে ইতিবাচক তাত্‌পয‍র্ বহন করবে।

কেন ফিরলেন জুবাইদা 

স্বামী তারেক রহমানের সঙ্গে লন্ডনের উদ্দেশে ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ছেড়েছিলেন ডা. জুবাইদা রহমান। এরপর একে একে ১৭টি বছর কেটে গেলেও দেশে ফিরতে পারেননি। 

নৌবাহিনীর সাবেক প্রধান মাহবুব আলী খানের কন্যা জুবাইদা পেশায় চিকিৎসক। ১৯৯৫ সালের বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারে প্রথম স্থান অর্জন করেছিলেন তিনি। দীর্ঘদিন চিকিৎসা পেশায় যুক্ত থাকলেও রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন না। তবে ২০০৮ সালে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তাঁর নামে দুর্নীতির মামলা হয় এবং তিন বছরের কারাদণ্ড ও ৩৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ২০১৪ সালে তিনি কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার অভিযোগে চাকরি হারান।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, জুবাইদা রহমান দীর্ঘদিন ধরেই বিএনপির রাজনীতির নেপথ্যে কাজ করছেন। হয়তো তারেক রহমান জুবাইদার চোখে বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন। পাশাপাশি পারিবারিক সুদৃঢ় বন্ধনের ইঙ্গিত তো আছেই।

দেশের রাজনীতিতে এই তিন নারী খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদুর রহমান। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাঁর দুই পুত্রবধূর দেশে ফেরা বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে আসার সঞ্চার করবে। শুধু তাই নয়, এরপর তারেক রহমানও আসবে, যা দেশকে নির্বাচনমুখী রাজনীতির দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে।

আলোচনায় আছেন জায়মা

ঠিক ওই রাজনৈতিক টানাপোড়েনের সময়ে (২০০৭-০৮) ১৩ বছর বয়সী জায়মা রহমান পরিবারের সঙ্গে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। তাঁর বয়স এখন ২৯ বছর। রাজধানীর ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ঢাকা (আইএসডি) থেকে বিদ্যালয় পর্যায়ের পড়াশোনা সম্পন্ন করার পর যুক্তরাজ্যে প্রবাস জীবন শুরু করেন জাইমা। পরে যুক্তরাজ্যের কুইন মেরি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর লন্ডনের ঐতিহ্যবাহী লিংকনস ইন থেকে ২০১৯ সালে বার অ্যাট ল সম্পন্ন করেন।

দীর্ঘদিন তিনি ছিলেন আলোচনার বাইরে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ফের নতুন করেন আসেন। মার্কিন কংগ্রেসের আয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে গত ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি ‘ন্যাশনাল প্রেয়ার ব্রেকফাস্ট’ অনুষ্ঠানে যোগ দেন জায়মা। সেখানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী অংশ নেন।

রাজনীতি সংশ্লিষ্ট অনেকে মনে করেন, ‘ন্যাশনাল প্রেয়ার ব্রেকফাস্ট’ স্রেফ একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলেও তাতে রাজনীতি সংশ্লিষ্ট বিশ্বনেতারা অংশ নিয়ে থাকেন। স্বয়ং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সেখানে উপস্থিত থাকেন। বিশ্বনেতাদের উপস্থিতিতে এমন অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক তাৎপর্য বহন করে।

আলোচনার বাইরে নেই শামিলাও 

আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শরমিলা রহমানও খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেশে এসেছেন। তাঁকে ঘিরে আলোচনা বাড়ছে। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে তাঁর রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা আছে কি না সে ব্যাপারে কখনো কিছু বলা হয়নি। তবে এ বারের দেশে ফেরাকে আলাদা করে দেখতে চাইছেন অনেকে। 

গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর লন্ডন থেকে ঢাকায় এসেছিলেন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শামিলা রহমান সিঁথি। ওইদিন দুপুরে তিনি গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের বাসভবন ফিরোজায় পৌঁছান। ওই বছরের ২৮ জানুয়ারি সবশেষ ঢাকায় এসেছিলেন তিনি।

খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে কোকো স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে মালয়েশিয়ায় থাকা অবস্থায় প্রায় এক দশক আগে মারা যান। তারপর থেকে শামিলা রহমান সন্তানদের নিয়ে লন্ডনে থাকছেন। সেখানে খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সপরিবারে ‘রাজনৈতিক আশ্রয়ে’ রয়েছেন।

শেষ সময়ে কি কথা হয়েছে মা-ছেলের

হিথ্রো বিমানবন্দরে খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার বড় ছেলে ও পুত্রবধূ জুবাইদা রহমান, মেয়ে জায়মা রহমান এবং ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমানের স্ত্রী সৈয়দা শামিলা রহমান ছিলেন। এ সময় বিমানবন্দরে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে পোস্ট করা এক ভিডিওতে এ দৃশ্য দেখা গেছে।

ভিডিওতে দেখা যায়, খালেদা জিয়া তারেক রহমানকে জিজ্ঞাসা করে বলেন, তুমি কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে? উত্তরে তারেক রহমান বলেন, তুমি বিমানে ওঠার পর জাইমাকে নিয়ে চলে যাব। এরপর তারেক জিয়ার সঙ্গে যারা ছিলেন তাদের উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেন, তোমরা ভাইয়ার (তারেক) খেয়াল রেখো।

গত ৮ জানুয়ারি লন্ডন ক্লিনিকে ভর্তি হন খালেদা জিয়া। কাতারের আমিরের শেখ তামিম বিন হামাদ আল সানির পাঠানো রাজকীয় বিশেষ অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকা থেকে লন্ডনের হিথ্রো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামেন তিনি। সেখান থেকে সরাসরি খালেদা জিয়াকে লন্ডন ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়। ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি লন্ডনের দ্য ক্লিনিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ২৫ জানুয়ারি চিকিৎসকদের ছাড়পত্র পেয়ে হাসপাতাল থেকে ছেলে তারেক রহমানের বাসায় ওঠেন।

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment