×

বিএনপি, জামাত ও এনসিপির সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক: লক্ষ্য অভিন্ন, তবে কৌশল ভিন্ন

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আলাদা আলাদা বৈঠক করেছে বিএনপি, জামাআত ও এনসিপি। শনিবার (২৪ মে) রাতে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় এ সব বৈঠক হয়। নির্বাচনের নিরপেক্ষতা রক্ষা এবং মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে তিনদলই মত দিয়েছে। তবে অন্যান্য দাবির ব্যাপারে কৌশলী অবস্থান ও মন্তব্য করেছেন দলের নেতাকর্মীরা। বিএনপি (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল) তিনজন উপদেষ্টাকে অপসারণের দাবি জানিয়েছে। জামায়াত বলেছে কাঠামোগত সংস্কারের কথা আর এনসিপি শেখ হাসিনার আয়োজনে হওয়া সব নির্বাচন অবৈধ ঘোষণার পাশাপাশি নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের দাবি তুলেছে। পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবও। বিস্তারিত জানাচ্ছেন মো. ইসতিয়াক 

তিন উপদেষ্টার অপসারণ চেয়েছে বিএনপি 

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘যেকোনো অজুহাতে নির্বাচন বিলম্ব করা হলে, দেশে আবার স্বৈরাচারের প্রত্যাবর্তনের পথ তৈরি হবে।’ তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ নয়, বরং তাঁকে সহযোগিতা করেই সরকারকে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়েছে বিএনপি।

লিখিতভাবে বিএনপি দাবি করেছে, নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান এবং দুই ছাত্র উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও মাহফুজ আলমের কারণে সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তাঁদের অপসারণ করে উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠন করতে হবে।

বিএনপির পক্ষ থেকে আলোচনায় অংশ নেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আবদুল মঈন খান ও সালাহউদ্দিন আহমদ।

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ ও স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।

নির্বাচন ও সংস্কারের রোডম্যাপ চায় জামায়াত

ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক শেষে জামায়াতে ইসলামির আমির শফিকুর রহমান বলেন, ‘নির্বাচনের সময়সূচি ও সংস্কার—এই দুটি বিষয়ে একটি সমন্বিত রোডম্যাপ প্রয়োজন। সংস্কার দৃশ্যমান না হলে নির্বাচন অর্থবহ হবে না।’

জামায়াত কোনো উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেনি। দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বর্তমানে অস্থিরতা আংশিক প্রশমিত হলেও স্থায়ী সমাধানের জন্য নির্বাচন ও সংস্কারের ওপর স্পষ্ট ও বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ থাকা আবশ্যক। দলটি নির্বাচনের পাশাপাশি রাজনৈতিক কাঠামোতে কাঠামোগত সংস্কারের ওপর জোর দিচ্ছে।

দলের নেতারা বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ও গ্রহণযোগ্যতা ফিরিয়ে আনাটাই জনগণের আস্থা অর্জনের অন্যতম প্রধান পথ। জামায়াতের পক্ষ থেকে বৈঠকে অংশ নেন দলটির আমির শফিকুর রহমান ও নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।

ইসি পুনর্গঠনের দাবি এনসিপির

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘শেখ হাসিনার আমলে অনুষ্ঠিত সকল জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন আনুষ্ঠানিকভাবে অবৈধ ঘোষণা করা প্রয়োজন। এ নির্বাচনগুলো রাজনৈতিক বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের স্থিতিশীলতায় সংকট সৃষ্টি করবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদ পরিবার ও আহতদের পুনর্বাসনের কাজ অত্যন্ত ধীরগতিতে চলছে, তাই সরকারকে তাঁদের জন্য প্রতিশ্রুত সঞ্চয়পত্র ও ভাতাসহ সকল সহায়তা বাস্তবায়নের দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।’

পাশাপাশি জুলাই ঘোষণাপত্র অবিলম্বে জারি করার জোর দাবিও জানিয়েছে দলটি। এনসিপির নেতাদের বক্তব্য, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে দ্রুত স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন ও নির্বাচন, সংস্কার, বিচার, গণপরিষদ ও আইনসভা নির্বাচনের ব্যাপক ও সুস্পষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন করাও সময়ের দাবি।

বৈঠকে এনসিপির পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন মো. নাহিদ ইসলাম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আরিফুল ইসলাম আদীব ও তাসনিম জারা।

নিশ্চিত সময়সীমা ও প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে নির্বাচনের আস্থা: প্রেস সচিব

সব বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সময় ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে রাখার বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিন দলই তাঁর নেতৃত্বে আস্থা রেখেছে এবং নির্বাচন তাঁর অধীনে আয়োজনের প্রত্যাশা করেছে।’

তিনি আরও জানান, প্রধান উপদেষ্টা বিচার প্রক্রিয়া এ মাসের মধ্যে শুরু করবেন এবং বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি উল্লেখ করেন, বিএনপি উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে, তবে সরকার এ বিষয়ে এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। এনসিপি মনে করে বর্তমান পরিস্থিতিতে সমান লেভেলে নির্বাচন সম্ভব নয়, তাই তারা নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের দাবি করেছে।

তিন দলের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট নির্বাচন ও সংস্কারের রোডম্যাপ চাওয়া হয়েছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রেস সচিব জানালেন, প্রফেসর ইউনূস বারবার বলেছেন, নির্বাচন অবশ্যই ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে হবে এবং জুনের ৩০ তারিখকে একনিষ্ঠ সময়সীমা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে।

তিন দলেরই অভিন্ন লক্ষ্য, কিন্তু কৌশল ভিন্ন

তিনটি দলের দাবির মধ্যে কিছু ঐকমত্য দেখা গেছে। সবাই একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি করেছে। নির্বাচনী রোডম্যাপ এবং অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা রক্ষার বিষয়েও দলগুলো একমত। তবে কৌশলগত ও রাজনৈতিক অবস্থানে রয়েছে সুস্পষ্ট পার্থক্য। সরকারও তাদের নিরপেক্ষতা আর নির্বাচন নিয়ে নিশ্চয়তা জানিয়েছে। সরকার আর দলগুলোর মধ্যে যে টানাপোড়েন চলছিল, তা আপাত কতটা প্রশমিত হলো, তা সময়ই বলে দেবে।

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment