×

ট্রাম্প প্রশাসনের ভিসা নীতি: হার্ভার্ডের শিক্ষাযুদ্ধ ও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের সংকট

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনের সংঘাত তীব্র হয়েছে। প্রশাসন বিদেশি শিক্ষার্থী ও গবেষকের ভিসা বাতিলের হুমকি দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের পদক্ষেপকে একাডেমিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে গুরুতর হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে আইনি লড়াই শুরু করেছে। এই বিরোধ শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, বিশ্বের উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যতকে প্রভাবিত করছে। কীভাবে হার্ভার্ড তাদের শিক্ষা ও স্বাধীনতার জন্য লড়ছে আর বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই-বা কীভাবে এর প্রভাব মোকাবিলা করছে। জানাচ্ছেন মো. ইসতিয়াক

২০১৭ সালে ট্রাম্প প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। বিশেষ করে যারা উদারনৈতিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং বহুজাতিক শিক্ষার্থী কাঠামো বজায় রাখতে চায়, তাদের নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের আর্থিক অনুদান ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা না রাখার অভিযোগে অভিযুক্ত হয় এবং প্রশাসনের তরফ থেকে প্রায় ২.৩ বিলিয়ন ডলার অনুদান বাতিলের হুমকি আসে।

এই অনুদান শুধু একাডেমিক গবেষণার জন্য নয় বরং প্রযুক্তি, চিকিৎসা, পরিবেশ এবং মানবাধিকার-সংক্রান্ত বহু উদ্যোগে ব্যবহার করা হতো। হার্ভার্ড কর্তৃপক্ষ জানায়, এমন পদক্ষেপ শুধু প্রতিষ্ঠানটির নয়, বরং সারা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চশিক্ষার ভাবমূর্তিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে।

হার্ভার্ডের এলামনাই ও সমর্থকরা দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে দ্বিগুণ অর্থ সংগ্রহ করে ফান্ডের ঘাটতি পূরণ করেন। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের চাপ এখানেই শেষ হয়নি। শিক্ষাসচিবের পক্ষ থেকে একটি চিঠি যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে গুরুতর বানান ও ব্যাকরণগত ভুলের কারণে তা অনলাইনে ভাইরাল হয় এবং একে একাডেমিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি অবজ্ঞাসূচক বলা হয়। এই ঘটনাটি আরও একটি বিতর্ক সৃষ্টি করে এবং প্রশাসনের কূটনৈতিক কার্যকলাপে তীব্র প্রশ্ন তোলে।

এরপর আবার ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের গবেষণা তহবিল বাতিল করা হয়, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কর্মকাণ্ডকে স্থবির করে দেওয়ার লক্ষ্যে নেওয়া একটি পদক্ষেপ। হার্ভার্ডের প্রেসিডেন্ট ও অধ্যাপকেরা নিজেদের বেতন কেটে এই ঘাটতি পূরণে উদ্যোগ নেন, যা শিক্ষার পক্ষে তাঁদের অঙ্গীকার ও দায়বদ্ধতার প্রতীক।

শিক্ষার পক্ষে আদালতের দ্বারে হার্ভার্ড
এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় আইনি পদক্ষেপ নেয়। তারা যুক্তি দেয়, সরকারের এই পদক্ষেপ শিক্ষার স্বাধীনতা লঙ্ঘন করছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে থাকা প্রথম সংশোধনীর বিরুদ্ধে যাচ্ছে।
হার্ভার্ড প্রেসিডেন্ট ল্যারি ব্যাকো এক বিবৃতিতে বলেন, ‘এই সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক শিক্ষার মর্যাদাকে চ্যালেঞ্জ করছে। শিক্ষা কখনোই ভিসার শর্তে জিম্মি থাকতে পারে না।’
ফেডারেল কোর্টে দায়ের করা মামলায় হার্ভার্ড দাবি করে, সরকারের এই পদক্ষেপ বৈজ্ঞানিক গবেষণার স্বাভাবিক ধারাকে ব্যাহত করবে এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের প্রতি অবিচার হবে।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মামলা শুধু একটি নিয়ম বাতিলের বিষয় নয়, এটি আসলে একাডেমিক স্বাধীনতা বনাম রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের গভীর দ্বন্দ্বের প্রতিচ্ছবি।

ভিসা-সংকট এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের আতঙ্ক
সবচেয়ে সাম্প্রতিক এবং ভয়াবহ পদক্ষেপ হলো হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিদেশি শিক্ষার্থী ও ভিজিটিং স্কলারদের স্টুডেন্ট অ্যান্ড একচেঞ্জ ভিসিটর ইনফরমেশন (এসইভিআইএস) লেটার বাতিলের হুমকি। এসইভিআইএস লেটার হলো যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে শিক্ষার অনুমোদনপত্র, যা না থাকলে শিক্ষার্থীরা আইনি অবস্থায় থাকবে না। প্রশাসন জানিয়েছে, আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্দেশ মেনে না চললে সব বিদেশি শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল করা হবে এবং তাদের দেশের বাইরে চলে যেতে হবে। এ ছাড়াও আগামী সেমিস্টারে নতুন বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভিসা দেয়া হবে না।
এ সিদ্ধান্তের জেরে প্রায় ৬ হাজার ৮ শ বিদেশি শিক্ষার্থী এবং ২০-২৫ জন ভিজিটিং স্কলার এক বিশাল অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরাও এর অংশ, যার মধ্যে অনেকেই হার্ভার্ডের উচ্চশিক্ষায় নিযুক্ত।

আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের মতামত
ভারতের গুজরাট থেকে আসা হিউম্যান রাইটস বিষয়ে মাস্টার্স করা শিক্ষার্থী বলেন মিরা প্যাটেল বলেন, ‘আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়কে আমার ভবিষ্যতের ভিত্তি হিসেবে দেখেছি, এখন সেটাই যেন রাজনৈতিক রোষানলে পড়ে আছে। আমাদের পড়াশোনার নিরাপত্তা আজ প্রশ্নের মুখে।’
মেক্সিকো থেকে আগত এক পিএইচডি গবেষক জানান, ‘আমরা জ্ঞান উৎপাদনে কাজ করছি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে গবেষণার চেয়ে রাজনৈতিক আনুগত্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।’
জাপান থেকে আসা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ইউকি নাকামুরা বলেন, ‘আমার পরিবার বহু ত্যাগস্বীকার করেছে এই শিক্ষার জন্য। এখন যদি হঠাৎ ফান্ড কেটে নেওয়া হয় এবং ভিসা বাতিল হয়, তাহলে আমরা কোথায় যাব?’

বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের চোখে হার্ভার্ড-ট্রাম্প সংঘাত
বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর শত শত শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান। তাদের বড় একটি অংশ বিশ্বের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে হার্ভার্ডকে চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করেন।
এই ঘটনার পর, বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা এবং অনিশ্চয়তা বাড়ছে। বিশেষ করে যারা স্কলারশিপ পেয়েছেন বা আবেদন প্রক্রিয়ায় ছিলেন, তাঁরা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দারুণ দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি ভিজিটিং স্কলার (নৃ-বিজ্ঞানী) নাসির উদ্দিন বলেন, ‘ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে হার্ভার্ডের এই লড়াই শুধু একাডেমিক স্বাধীনতার ব্যাপার নয়, এটা একটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিরোধের গল্প। যখন রাষ্ট্র শিক্ষা ও গবেষণার ওপর অবরোধ আরোপ করে, তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের অবস্থান সুরক্ষায় কঠোর হস্তক্ষেপ নিতে হয়। হার্ভার্ডের মতো প্রতিষ্ঠান যখন নিজের অর্থায়ন দিয়ে, শিক্ষকদের বেতন কেটে এই যুদ্ধ চালায়, তখন বোঝা যায় এই লড়াই কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু হার্ভার্ড বা যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যা নয়, বিশ্বের সকল শিক্ষার্থীর স্বাধীনতা এবং ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িত।’

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং ভবিষ্যতের আশঙ্কা
এই ঘটনার আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াও কম নয়। বিবিসি, নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য গার্ডিয়ানসহ প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমগুলো বিষয়টি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছে। অনেকেই এই পদক্ষেপকে ‘শিক্ষার ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দেওয়া’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার। রাজনৈতিক অবস্থানের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের ভিসা বাতিল করা আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।’
বিশ্বের অনেক দেশই এই ঘটনার প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের শিক্ষাবিষয়ক মন্ত্রী সভায় বিষয়টি উত্থাপিত হয়। তারা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এমন আচরণ বিশ্বজুড়ে শিক্ষার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

শিক্ষা কি রাজনৈতিক অস্ত্র
ইন্ডিপেন্ডেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তানভীর হারুন বলেন এই ঘটনার মাধ্যমে এক প্রশ্ন সামনে উঠে আসে, শিক্ষা কি এক রাজনৈতিক কৌশলের উপাদান হয়ে পড়ছে? হার্ভার্ডের মতো স্বাধীনচেতা প্রতিষ্ঠান যদি রাষ্ট্রীয় চাপের মুখে পড়ে, তবে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা কী হবে?
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একাত্মতা প্রকাশ করছেন। তাঁরা বলছেন, ‘এই লড়াই শুধু হার্ভার্ডের নয়, এটি আমাদের সবার।’
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ঐতিহ্য ও অবস্থান থেকে সরছে না। তারা বলছে, ‘আমরা শিক্ষা, ন্যায়বিচার ও বৈচিত্র্যের পক্ষে দাঁড়াব। আমাদের ক্যাম্পাস সব সময় বিশ্বজনীন চিন্তার আশ্রয়স্থল হয়ে থাকবে।’
এই লড়াইয়ের শেষ কোথায়, তা সময়ই বলে দেবে। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত—শিক্ষা নিয়ে এই যুদ্ধ প্রমাণ করেছে, জ্ঞান অর্জন শুধু ক্লাসরুমে সীমাবদ্ধ নয়, এটি অনেক সময় সত্য ও স্বাধীনতার জন্য রাস্তায়ও নামে।

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment