নির্মম নির্যাতনের পর ৭৮ জনকে সুন্দরবনের চরে ফেলে গেল বিএসএফ
কারো জন্ম ভারতেই, কেউ সেখানে বাস করছেন তিনযুগের বেশি সময় ধরে। তবে তাঁদের বাংলাদেশি হিসেবে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী সুন্দরবনের মান্দারবাড়িয়া চরে ফেলে গেছে ভারতীয় কোস্টগার্ড ও সীমান্ত রক্ষী-বিএসএফ। শুক্রবার (৯ মে) ৭৮ ব্যক্তিকে উদ্ধার করেছে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড। তাদের মধ্যে ৭৫ জন বাংলাদেশি মুসলিম ও তিনজন ভারতীয় মুসলিম বলে জানিয়েছে উদ্ধারকারি বাহিনীটি। এর আগে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে আটক রেখে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে বলছেন উদ্ধার ব্যক্তিরা। তাঁদের শরীরেও মিলছে সেসব নির্যাতনের ক্ষত চিহ্ন।
৭৮ ব্যক্তিকে উদ্ধারের বিষয়ে মঙ্গলবার (১৩ মে) সকালে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছেন কোস্ট গার্ড মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার হারুন-অর-রশীদ। এতে জানানো হয়, উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের অধিকাংশই দীর্ঘদিন যাবৎ ভারতের গুজরাট রাজ্যে বসবাস করছিলেন এবং বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।
চলতি বছরের ২২ এপ্রিল দুপুরে ভারত শাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এর চার দিন পর (২৬ এপ্রিল) গভীর রাতে ভারতীয় প্রশাসন ওইসব ব্যক্তিকে বাসা থেকে আটক করে। শুক্রবার (৯ মে) ভোরের দিকে গোপনে সুন্দরবনের মান্দারাড়ি চরে রেখে যায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। পরে তারা মান্দারবাড়িয়া চর থেকে গিয়ে মান্দারবাড়ি ফরেস্ট অফিসে আশ্রয় নেন। পরে খবর পেয়ে প্রয়োজনীয় খাবার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করে কোস্টগার্ড। উদ্ধার ব্যক্তিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ সব তথ্য জানানো হয়েছে।
ভারতে ঘটনার শুরু ২৬ এপ্রিল
উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশিরা জানান, তাদের অনেকে দুই-তিন যুগ ধরে ভারতের গুজরাট রাজ্যে বসবাস করছেন। কেউবা দুই মাস থেকে শুরু করে পাঁচ-ছয় বছর ধরেও সেখানে অবস্থান করছেন। তবে ২৬ এপ্রিল ভোরের দিকে রাজ্যটির আহমেদাবাদ এলাকার কয়েকশ পুলিশ ও স্পেশাল ব্রাঞ্চের সদস্যরা বস্তি ঘেরাও করে। এ সময় তাঁদের আটকের পাশাপাশি বস্তি ভেঙে ফেলা হয়। এ সময় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে পর্যন্ত দেখা করতে দেয়া হয়নি। পরে তাঁদের বাংলাদেশে ফেলে গেলেও গুজরাটে অবস্থানরত তাঁদের স্ত্রী-সন্তানরা কোথায় আছে, সেটা বলতে পারছেন না।
বাংলাদেশের নড়াইল জেলার চাতুরী গ্রামের তালেব শেখের ছেলে ফুয়াদ শেখ। তিনি জানান, ফজরের আজান দেওয়ার কিছু আগে তাঁদের বস্তি ঘেরাও করা হয়। অনেকের সঙ্গে তাঁকেও প্রথমে পুলিশ স্টেশনে, পরে অন্যখানে নিয়ে আটকে রাখা হয়। ৫ মে কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে দিয়ে পিছমোড়া করে দুই হাত বেঁধে বিমানে তোলা হয়। ওই অবস্থায় একদিন রাখার পর ৯ মে তাঁদের জাহাজে উঠিয়ে বেপরোয়া মারধরের পর মধ্যরাতে (রাত ১২টার দিকে) লাইফ জ্যাকেট পড়িয়ে বঙ্গোপসাগরের চরে ফেলে যায়।
প্রকৃতির ডাকেও নির্যাতন
উদ্ধার ব্যক্তিদের মধ্যে আবজাল মৃধা ও তাঁর রাহাতের বাড়ি নড়াইলের কালিয়ার জয়পুর গ্রামে। আবজাল মৃধা জানান, রাহাতকে নিয়ে তিনি আহমেদাবাদে প্লাস্টিক কুড়ানোর কাজ করতেন। ২৬ এপ্রিল ফজরের নামাজের সময় গুজরাটের শাহআলম চান্ডালের মুসলিম বস্তি থেকে তাঁদের ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। বিভিন্ন স্থানে আট-নয় দিন আটকে রাখার সময় পিতা-পুত্রকে বেপরোয়া মারধর করা হয়।
তিনি অভিযোগ করেন, বিমানে ওঠানোর আগে চোখ ও হাত-পা বাঁধার পাশাপাশি বিমান থেকে নামিয়ে বাসে জাহাজে পৌঁছে দেওয়ার পর সবচেয়ে বেশি মারধর করা হয়। প্রকৃতিক ডাকের (প্রস্রাব-পায়খানা) কথা বললেই তাঁদের প্রত্যেকের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হতে বলেও দাবি করেন তারা। এ সময় ‘বাংলাদেশি’ বলে গালিগালাজও করে আটককারীরা।
উদ্ধার ব্যক্তিদের ভাষ্য, আটকের সময় তাঁদের সামান্য বিস্কুট ও পাউরুটি আর পানি দেওয়া হতো। বেপরোয়া মারপিট করা হতো। এ সময় অনেকের পিঠ ও কোমরের নির্যাতনের চিহ্ন দেখান।
হঠাৎ স্বজনের বিচ্ছেদ
‘স্ত্রী সন্তানদের ফিরে না পেলে আমি বেঁচে থেকে কি করব?’ বলছিলেন নড়াইলের কালিয়া উপজেলার ফুয়াদ শেখ। তিনি জানান, তাঁর তিন কন্যাশিশু ও স্ত্রী এখনো গুজরাটে রয়েছে। আটক করার পর পরিবারের সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করতে দেওয়া হয়নি।
একইভাবে আট সন্তান ও স্ত্রীকে রেখে ৩৭ বছর পর একাই ফিরেছেন হারুন শেখ। পেশায় রাজমিস্ত্রি হারুন ১৭ বছর বয়সে ১৯৮৮ সালে তিনি ভারতে পাড়ি জমান। ২০০০ সালে কলকাতার মেয়ে পারভীনকে বিয়ে করে গুজরাটের সুরাটে বসবাস শুরু করেন তিনি। এক পর্যায়ে কিছু জায়গা-জমি কেনেন। সন্তানদের ভর্তি করিয়ে দেন স্থানীয় মক্তব ও মাদ্রাসায়। এরই মধ্যে তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন সেখানে। অন্য সন্তানেরা পড়ালেখা করে। তবে ২৬ এপ্রিল মুহূর্তের মধ্যে তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে আটকে রাখার প্রায় পনের দিন পর সুন্দরবানের চরে ফেলে গেছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।
স্বজনদের ফিরে পেতে আকুতি
হারুন শেখ একা বাংলাদেশে পৌঁছালেও পরিবারের সদস্যদের দুচিন্তায় বার বার মুর্ছা যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ‘বাচ্চারা কেউ নুরানি, আবার কেউ হেফজ পড়ছে। না জানি তাদের সাথে কী ব্যবহার করা হচ্ছে!’ বাংলাদেশ ছেড়ে আর যাবেন না— উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, সরকার যদি তার পরিবারকে উদ্ধারের ব্যবস্থা নিত, তবে তিনি খুশি মনে মরতে পারতেন।
ফিরে আসা জাহিদ শেখ জানান, তাঁর স্ত্রী রত্না পারভীন ও পাঁচ ছেলে-মেয়ে এখনো গুজরাটে আছে। দুই মেয়েকে সেখানে বিয়েও দিয়েছেন। তিনি আর ভারতে যেতে চান না। তাঁর অবস্থা নিয়েও সেখানকার স্বজনরা হয়তো আরো বেশি চিন্তিত। তাই সেখানে অবস্থানরত স্ত্রী-সন্তানদের ফিরে পাওয়ার জন্য আরো অনেকের মতো তিনি সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
ভারতে জন্মে ‘অনুপ্রবেশকারী’ তিন তরুণ
ভারতীয় কোস্টগার্ড ও বিএসএফের রেখে যাওয়া ৭৮ জনের মধ্যে ৭৫ জনকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে মঙ্গলবার (১৩ মে) দুপুর ১২টার দিকে। সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানায় তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তবে পিতা-মাতা সবাই বাংলাদেশী হওয়া সত্ত্বেও ভারতে জন্ম হওয়ার কারণে তিন তরুণকে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে চিহ্নিত করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এজহারে উল্লেখ করা হয়েছে, পিতা-মাতার গুজরাটে অবস্থানকালে গুজরাটের ফুলবাড়িয়া এলাকার নেহেরীনগর জোপারপাচ্চি এলাকায় তাদের জম্ম।
‘অনুপ্রবেশকারী’ তিনজন হলেন খুলনার বটিয়াঘাটা থানার খালিদ শেখ ও কাকলী দম্পতির ছেলে আব্দুর রহমান (২০), নড়াইলের কালিয়া থানার বিষ্ণুপুর গ্রামের মৃত মুন্না শাহ ও মৃত নুরজাহান বেগমের ছেলে মো. হাসান শাহ (২২) এবং সোহেল শেখ ও সাবিনা দম্পতির ছেলে সাইফুল শেখ (১৯)।
কী বলছে পুলিশ
সুন্দরবনের মান্দারবাড়িয়া চর থেকে উদ্ধারের পর পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য শনিবার (১১ মে) ৭৮ জনকে সাতক্ষীরা শ্যামনগর থানায় হস্তান্তর করে কোস্টগার্ড।
সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার (এসপি) মনিরুল ইসলাম বলেন, চর থেকে উদ্ধার তিনজনের বিরুদ্ধে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগ এনেছে কোস্টগার্ড। তাঁরা ভারতীয় নাগরিক বলে দাবি করেছেন। এ জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে শ্যামনগর থানায় মামলা হয়েছে, বর্তমানে কারাগারে। মামলার তদন্তকালে পরিবারের সদস্যরা যদি উপযুক্ত কাগজপত্র উপস্থাপন করতে পারেন, তাহলে তদন্ত কার্যক্রম সেদিকে ধাবিত হবে। যদি সেটি না হয়, তারা ভারতীয় নাগরিক হয়ে থাকেন, তাহলে তাদের ভারতীয় দুতাবাসে যোগাযোগের মাধ্যমে সে দেশের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে অনুরোধ করা হবে।
এসপি মনিরুল বলেন, উদ্ধার ব্যক্তিদের মধ্যে ৭৫ জন বাংলাদেশি নাগরিক। তারা নড়াইল, যশোর, খুলনা, ঢাকা ও সাতক্ষীরার বাসিন্দা। তবে অধিকাংশই নড়াইল জেলার। তাদের তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে পরিবার ও নিকট স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment