×

যে আইনি জটিলতার কারণে শপথ নিতে পারছেন না ইশরাক

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র হিসেবে আদালতের রায়ে জয়ী বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন এখনও শপথ নিতে পারেননি। নির্বাচন কমিশন গেজেট প্রকাশ করলেও শপথ অনুষ্ঠান নিয়ে আইনি জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় তা পিছিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে আইনি পরামর্শ চেয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে এই বিলম্বের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় দিনের মতো বিক্ষোভে উত্তাল ছিল নগর ভবনের সামনের এলাকা। ১৭ মে শনিবার সচিবালয় অভিমুখে মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে আন্দোলনকারীরা। ঠিক কোন আইনি জটিলতার কারণে শপথ নিতে পারছেন না ইশরাক, জানাচ্ছেন মো. ইসতিয়াক 

গেজেট প্রকাশের পরও শপথে বিলম্ব

২০২০ সালের নির্বাচনে পরাজিত হয়ে কারচুপির অভিযোগে আদালতে যান বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন। দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়ার পর গত ২৭ মার্চ আদালত তাঁকে জয়ী ঘোষণা করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন গত ২৭ এপ্রিল গেজেট প্রকাশ করে।

তবে শপথ অনুষ্ঠান আয়োজনের আগেই একটি আইনি ব্যাখ্যা ঘিরে সমস্যার সৃষ্টি হয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় গেজেট হাতে পাওয়ার পর শপথের প্রস্তুতি শুরু করলেও আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল মন্তব্য করেন, ‘আমাদের মতামত চাওয়ার আগেই গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে, এতে আমাদের কিছু বলার নেই।’ এই বক্তব্যের পর শপথ কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। 

আইনি জটিলতা: কোন ধারা সামনে আনা হচ্ছে

সরকার এখন বিষয়টি ‘স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯’ অনুযায়ী যাচাই করে দেখতে চাচ্ছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় আইনি পরামর্শ চেয়ে যে চিঠি দিয়েছে, তাতে উল্লেখ রয়েছে, ধারা ১২(২) অনুসারে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত ব্যক্তি শপথ নেওয়ার পর দায়িত্ব পালন করতে পারেন। শপথ না নেওয়া পর্যন্ত নির্বাচিত হলেও মেয়রের কার্যকর ক্ষমতা শুরু হয় না। ধারা ১৬(২) বলছে, মেয়র বা কাউন্সিলরদের দায়িত্বের মেয়াদ ৫ বছর, যা শপথ নেওয়ার দিন থেকে গণনা শুরু হয়। ধারা ১৬(৩) অনুযায়ী, মেয়াদ শেষ হলে নতুন নির্বাচিত মেয়র দায়িত্ব না নেওয়া পর্যন্ত প্রশাসক নিযুক্ত থাকতে পারেন।   

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় চিঠিতে প্রশ্ন তুলেছে, যেহেতু মেয়াদকাল শেষ হচ্ছে ২ জুন, এবং আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন কোনো আপিল করেনি, তাহলে এ অবস্থায় শপথ গ্রহণে কোনো আইনি বাধা আছে কি না। 

চিঠিতে আরও বলা হয়, নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের রায়ে একতরফাভাবে ইশরাককে জয়ী ঘোষণা করা হয়েছে, কারণ নির্বাচন কমিশন সেখানে নিজে কোনো প্রকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি। এছাড়া আরজি সংশোধনের বিষয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে ট্রাইব্যুনাল রায় দিয়েছে- এমন অভিযোগও উত্থাপন করা হয়েছে।

রিট, আপিল ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

শুধু আইনি ব্যাখ্যার জায়গা নয়, ইশরাকের মেয়র হওয়া নিয়ে রাজনৈতিক বিরোধ ও রিট দায়েরও পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। বুধবার হাইকোর্টে এক ব্যক্তির পক্ষে দায়ের করা রিটে ইশরাককে মেয়র হিসেবে শপথ না পড়ানোর নির্দেশনা চাওয়া হয়। একইসঙ্গে ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণায় ‘জালিয়াতি ও প্রতারণা’র অভিযোগ আনা হয়েছে এবং বিচারকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার দাবি জানানো হয়েছে।  

আন্দোলন ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দিনের মতো হাজারো কর্মী সমর্থক নিয়ে ‘ঢাকাবাসী’ ব্যানারে নগর ভবনের সামনে বিক্ষোভ করেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। স্লোগান ওঠে, ‘শপথ নিয়ে টালবাহানা চলবে না’, ‘জনতার মেয়র ইশরাক ভাই’, ‘আমাদের মেয়র আমরাই বানাব’। নগর ভবনের ভেতরে প্রবেশ করে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। অনেক কর্মচারীও সংহতি জানান, ভবনের ফটকে তালা দিয়ে কর্মবিরতিতে যান তাঁরা।

ইশরাক হোসেনের দাবি, তিনি ন্যায়বিচার পেলেও একটি অদৃশ্য মহল থেকে তাঁর শপথ বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে।

সমান্তরাল দাবি খুলনায় 

খুলনা সিটি করপোরেশনের পরাজিত স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী এস এম শফিকুর রহমান ইসিতে গিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এ সময় তিনি ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে তাঁকে বিজয়ী ঘোষণার দাবি জানান। ওই নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনি জামানত হারিয়েছিলেন।

২০২৩ সালের খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জামানত হারিয়েছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এম শফিকুর রহমান। ওই নির্বাচনে জয়ী ঘোষণার দাবি জানিয়ে ১৫ মে বৃহস্পতিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে দেখা করেছেন তিনি।

ভোট পুনরায় গণনা করা হলে জয়ী হবেন দাবি করে শফিকুর রহমান সিইসি, নির্বাচন কমিশনের সচিব ও স্থানীয় সরকার বিভাগে তিনটি দরখাস্ত পাঠান। কিন্তু কোনো জবাব না পেয়ে উচ্চ আদালতে রিট করেন। তাঁর দাবি, আদালত তাঁর পক্ষে রায় দিয়েছেন। ৩০ দিনের মধ্যে তিনটি দরখাস্ত ‘ডিসপোজাল’ করার জন্য বলেছেন।

২০২৩ সালের খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১৭ হাজার ২১৮ ভোট পেয়ে চতুর্থ হন শফিকুর রহমান।

বলা দরকার, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর গত বছরের ১৯ অক্টোবর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১২টি সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত মেয়র অপসারণ করে সেখানে প্রশাসক নিয়োগ দেয়। সিটি করপোরেশনগুলো হলো, ঢাকা দক্ষিণ, ঢাকা উত্তর, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, রংপুর, গাজীপুর ও ময়মনসিংহ।

২০২০ সালের ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী ইশরাক হোসেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পান। তবে এই ফলকে চ্যালেন্জ করে দায়ের করা মামলার রায়ে গত ২৭ মার্চ তাঁকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। 

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment