×

৫ মাসে ১০ খুন: ‘স্বস্তির’ বিআরটি প্রকল্প এখন ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্য

স্ট্রিম প্রতিবেদক

সম্প্রতি টঙ্গী চেরাগআলী ফ্লাইওভারে ছিনতাইয়ের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ভাইরাল হওয়া ওই ভিডিওতে দেখা যায়, মোটরসাইকেলে আসা তিন ছিনতাইকারী চাপাতি হাতে এক পথচারীকে ধাওয়া করছে। লোকটি দৌড়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করলে ছিনতাইকারীরাও তাঁর পেছনে ছুটতে থাকে। এ সময় আশপাশের লোকজনের ডাকচিৎকারে শেষ পর্যন্ত পালিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। তবে সব সময় এমন সৌভাগ্য হয় না।

৩০ বছর বয়সী রঞ্জু একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। প্রতিদিনের মতো কাজ শেষে শুক্রবার (১৬ মে) রাতেও নিজের মোটরসাইকেলে টঙ্গীর সাতাইশে তাঁর বাসায় ফিরছিলেন। পথে বাটা গেট এলাকায় ছিনতাইকারীরা তাঁর গতিরোধ করে। এ সময় ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে তাঁকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

ঢাকা-গাজীপুর বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পটি যানজট ও নাগরিক দুর্ভোগ দূর করে স্বস্তি আনার জন্য চালু হয়েছে বিশাল ফ্লাইওভারটি। গাজীপুর থেকে রাজধানীর হজরত শাহজালাল বিমানবন্দর পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভারটি অনেক জায়গা পরিণত হয়েছে ছিনতাইকারীদের ‘অভয়ারণ্যে’।

প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ঘটছে ছিনতাই, চুরি, প্রাণহানিসহ গুরুতর আহত হওয়ার মতো ঘটনা। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত ছিনতাইকারীদের হাতে ১০টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। ফলে জনসাধারণের নিরাপদ ফ্লাইওয়ার যাতায়াতের স্বপ্নের আজ পরিণত হয়েছে এক দুঃস্বপ্নে।

এর আগেও স্টেশন রোড ফ্লাইওভার ওপরে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। এতে দেখা যায়, এক যুবক ধারালো চাপাতি হাতে অজ্ঞাত আরেক যুবককে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে তাঁর মোবাইল ফোন, মানিব্যাগসহ মূল্যবান মালামাল ছিনিয়ে নিচ্ছে। এসব রক্ষায় অনুনয়-বিনিয় করলে চাপাতি দিয়ে যুবককে কোপাতে উদ্ধত হয়। ভাইরাল হওয়া দুটি ভিডিও ফুটেজই দিনের বেলার।

এ ধরনের ঘটনা এখন প্রায় নিত্যদিনের চিত্র। টঙ্গী স্টেশন রোড, টঙ্গী বাজার, বাটা গেট, বনমালা রেলগেট, হকের মোড়, গাজীপুরা, মিলগেটসহ অন্তত ৮-১০টি স্থানে নিয়মিত ঘটছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও এখন এসব সংঘবদ্ধ ছিনতাইচক্রে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।

কী বলছে পুলিশ

টঙ্গীতে কর্মরত পুলিশের বিশেষ বাহিনীর একটি সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকেই বিআরটি প্রকল্প এলাকায় ছিনতাইকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। অতীতে তারা ভয়ভীতি দেখিয়ে মূল্যবান সামগ্রী ছিনিয়ে নিলেও, এখন হত্যা বা হত্যা চেষ্টার মতো গুরুতর অপরাধ করতেও দ্বিধা করছে না। সহকারী পরিদর্শক (এসআই) পদমর্যাদার ওই সূত্র আরও জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ছিনতাইকারীদের হাতে প্রায় ১০টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। একই সময় ছিনতাইকারী সন্দেহে অন্তত পাঁচজন উপস্থিত লোকজনের মারধরে প্রাণ হারিয়েছেন। তার আগে পাঁচ মাসে একই সংখ্যক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, যার অধিকাংশ ছিনতাইসংশ্লিষ্ট ঘটনায়।

ফ্লাইওভার ও আশাপাশের এলাকায় ছিনতাইসহ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল গাজীপুর মেট্রোপলিটনের অপরাধ (দক্ষিণ) বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার এন এম নাসির উদ্দিনের কাছে। মোবাইল ফোনে তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতিদিনই ছিনতাইকারী গ্রেপ্তার করছি, ফ্লাইওভারগুলোতে ফিক্সট ডিউটি দিয়েছি এবং ভ্রাম্যমাণ তদারকি বাড়ানো হয়েছে। ছিনতাইকারীরা তাদের কাজ করছে, আমরা আমাদের কাজ করছি।’

স্থানীয় বাসিন্দা ও যাত্রীরা যা বলছেন

ঢাকার মালিবাগে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন টঙ্গী পূর্ব থানাধীন গাজীপুর এলাকার বাসিন্দা শাহিনুর রহমান। নিয়মিত বিআরটি বাসে যাতায়াত করেন। বিআরটিএ প্রকল্পের ফ্লাইওভারগুলো কতটুকু জনসাধারণের জন্য নিরাপদ—এমন প্রশ্ন করা হয় তাঁর কাছে। তিনি বলেন, ‘প্রায়ই টঙ্গী থেকে গাজীপুরের দিকে রাতে ফিরতে ভয় লাগে। কিছুদিন আগে বিকেলে চেরাগআলী এলাকার ফ্লাইওভারের ওপরে বাস থেকে নামার সময় এক যুবক আমার মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়। চিৎকার করেও কোনো ফল হয়নি। প্রায়ই এমন ঘটনা ঘটতে দেখছি। এই সড়কে এখন চলতে হয় আতঙ্ক নিয়ে।’

টঙ্গীর চেরাগআলীর পাশেই থাকেন স্থানীয় বাসিন্দা হুসনা বানু। তিনি বলেন, ‘ফ্লাইওভারটা বানানো হয়েছিল শহরের যানজট কমাতে, কিন্তু এখন তো এখানে হাঁটতেই ভয় লাগে। আমাদের বাসার ছাদ থেকে প্রায়ই দেখি ছিনতাইকারীরা চাপাতি হাতে লোকজনকে ধাওয়া করছে।’

টঙ্গীর হোসেন মার্কেট এলাকায় বাসিন্দা জুবায়ের হোসেন একজন মোটরসাইকেলচালক। পেশাগত কারণে প্রায় প্রতিদিনই ফ্লাইওভার ব্যবহার করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘রাত ১০টার পর ফ্লাইওভারে যাওয়া মানেই ভয়। কিছু দিন আগে এক যাত্রীকে নামিয়ে দেওয়ার সময় দুজন এসে আমার বাইকের সামনে দাঁড়িয়ে যায়। কোনোরকমে দ্রুত চলে গিয়ে প্রাণে বেঁচেছিলাম। ফ্লাইওভারে যদি নিয়মিত টহল থাকত, এসব এতটা বাড়ত না।’

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

নিরাপতা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদক, কিশোর গ্যাং, অনলাইন জুয়া এবং রাজনৈতিক প্রভাব— এই চারটি কারণেই ছিনতাই ও সহিংসতা বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। বারবার প্রশাসনের সামনে এসব অপরাধ সংঘটিত হলেও মূল হোতারা থেকে যাচ্ছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) গাজীপুর মহানগর সভাপতি অধ্যক্ষ মনিরুল ইসলাম রাজিব বলেন, ‘এই অপরাধগুলো সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। কিশোর গ্যাং ও মাদকচক্রের পেছনে থাকা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।’ তিনি আরও বলেন, নগরবাসীর এখন একটাই প্রত্যাশা, যত দ্রুত সম্ভব ফ্লাইওভারটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক। না হলে হাজার কোটি টাকার এই বিআরটি প্রকল্প ‘উন্নয়নের প্রতীক’ নয়, হয়ে উঠবে নগরবাসীর জন্য এক ভয়ংকর মরণফাঁদ।

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment