৪ বছরে আদালতে কোন দিন কী করেছিলেন পরীমনি
স্ট্রিম প্রতিবেদক
চিত্রনায়িকা পরীমনি বিভিন্ন সময়ে তাঁর দায়ের করা মামলায় এবং তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার শুনানিতে অংশ নিতে আদালতে গিয়েছেন। সর্বশেষ চলতি বছরের ২৬ মে সোমবার তিনি আদালতে হাজির হয়েছিলেন বোট ক্লাবে শ্লীলতাহানির অভিযোগের মামলায় আসামিপক্ষের আইনজীবীদের জেরায় অংশ নিতে।
তবে প্রচণ্ড গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ায় দিনের শেষভাগে জেরা না হয়েই তিনি আদালত ত্যাগ করেন একসময়ের আলোচিত এই অভিনেত্রী। শারীরিক অসুস্থতার কারণে জেরার তারিখ পিছিয়ে দেন বিচারক। এদিন ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদ, তুহিন সিদ্দিকী অমি ও আরও একজনের বিরুদ্ধে করা মামলায় তাকে জেরা করার দিন ধার্য ছিল।
যেভাবে মামলায়
২০২১ সালের ৮ জুন পরীমনি অভিযোগ করেন, সাভারের ঢাকা বোট ক্লাবে তাঁকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। তিনি ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছেন। এ বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্টের পর সংবাদ সম্মেলনে আসেন তিনি।
এরপর ১৪ জুন পরীমনি নিজে বাদী হয়ে সাভার মডেল থানায় ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। এই মামলায় বোট ক্লাবের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য নাসির উদ্দিন মাহমুদকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পাল্টা মামলা
২০২২ সালের ৬ জুলাই পরীমনির দায়ের করা মামলার বিচার চলাকালে নাসির উদ্দিন পাল্টা মামলা করেন পরীমনি ও আরও দুজনের বিরুদ্ধে।
মামলায় তিনি অভিযোগ করেন, সেদিন বোট ক্লাবে পরীমনি মদ্যপান করে টাকা না দিয়ে চলে যেতে চাইলে তিনি বাধা দেন। পরে পরীমনি তাঁকে গালিগালাজ করে একটি গ্লাস ও মোবাইল ফোন ছুঁড়ে মারেন। যাতে তিনি আঘাত পান। নাসিরের দাবি, এই ঘটনাকে ঢাকতেই পরীমনি তাঁর বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ তোলেন।
কারাবাস থেকে মুক্তি: ২৭ দিনের আলোচিত অধ্যায়
২০২১ সালের ৪ আগস্ট বিকেল ৪টার পর পরই বনানীর ১২ নম্বর রোডের পরীমনির বাসায় অভিযান পরিচালনা করে র্যাব। এ সময় ওই বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দামি মদ, মদের বোতলসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য জব্দ করার কথা সংবাদমাধ্যমে জানানো হয়।
প্রেফতারের পর মাদক মামলায় তাঁকে রিমান্ডেও নেওয়া হয়। মোট ৭ দিনের রিমান্ডে ছিলেন তিনি। ৫ আগস্ট চার দিন ও ১০ আগস্ট পরীমনির দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। রিমান্ড শেষে ১৩ আগস্ট তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর ১৯ আগস্ট তৃতীয় দফায় একদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। সেই রিমান্ড শেষে ২১ আগস্ট কারাগারে পাঠানো হয় পরীমনিকে।
তিন দফা জামিন আবেদন নামঞ্জুর হওয়ার পর চতুর্থ দফায় ৩১ আগস্ট তাঁর জামিন মঞ্জুর হয়। পরের দিন ১ সেপ্টেম্বর রিমান্ডের সময়সীম বাদে ১৯ দিন কারাবাসের পর কাশিমপুর মহিলা কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। এ সময় আদালত চত্বরে তাঁকে ফুল দিয়ে বরণ করা হয়।
পরীমনি ও আদালত
অভিনয় আর মাঝেমধ্যেই আদালত। মাদক মামলার অভিযোগ থেকে শুরু, তারপর পাল্টা মামলা, হাজিরা, রিমান্ড, জামিন – সব মিলিয়ে চার বছর পেরিয়ে গেলেও শেষ হয়নি পরীমনির আইনি লড়াই। আদালতের বারান্দা যেন এই ঢাকাই তারকার আরেকটা পরিচিত মঞ্চ হয়ে উঠেছে।
নিচে তারিখের ক্রমানুযায়ী পরীমনির আদালত-পরিক্রমা সাজানো হলো:
২০২১ সাল
১৫ সেপ্টেম্বর
মাদক মামলায় ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজিরা দেন। বিচারক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ১০ অক্টোবর দিন ধার্য করেন।
১০ অক্টোবর
আদালতে উপস্থিত হয়ে জামিন আবেদন করেন, শুনানিকালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। আদালত তাকে জামিন দেন। আদালত থেকে জানানো হয়, পরীমনির কাছ থেকে মাদক উদ্ধার হওয়ার বিষয়টি প্রমাণ হয়েছে। এ দোষে তিনি দোষী। তাই তাঁর বিরুদ্ধে বিচারিক আদালতে বিচার শুরু হবে। তাই মামলাটি ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে বদলি করা হয়।
২৬ অক্টোবর
মাদক মামলার অভিযোগপত্র আমলে নেওয়ার শুনানিতে অংশ নেন। এ উপলক্ষে সকালে আদালতে হাজির হন পরীমনি। তিনি জামিন চাইলে তা মঞ্জুর করেন আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক। এ ছাড়া অভিযোগপত্র আমলে নেওয়ার বিষয়ে শুনানির জন্য ১৫ নভেম্বর তারিখ রাখেন আদালত।
১৫ নভেম্বর
ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত তার বিরুদ্ধে মাদক মামলার অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। মামলার অন্য দুই আসামি হলেন-পরীমনির সহযোগী আশরাফুল ইসলাম দিপু ও মো. কবীর হাওলাদার।
২০২২ সাল
২৯ নভেম্বর
পরীমনি ও তাঁর সাবেক স্বামী অভিনেতা শরীফুল রাজ একসঙ্গে আদালতে যান। সে সময় আসামি অমি ও শহিদুল হাজিরা দেন। দুই আসামির উপস্থিতিতে পরীমনির সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। এরপর আদালত পরীমনির আংশিক জবানবন্দি রেকর্ড করেন
২০২৩ সাল
১১ জানুয়ারি, ৬ মার্চ, ২৩ মে ও ১৩ সেপ্টেম্বরে সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ধার্য তারিখ গুলোতে আদালতে পরীমনি অনুপস্থিত থাকায় সাক্ষ্যগ্রহণ স্থগিত হয়।
২৪ জুলাই
বোট ক্লাব মামলায় আংশিক সাক্ষ্য দেন পরীমনি। আদালতে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। ট্রমার কথা জানিয়ে ক্যামেরা ট্রায়ালের আবেদন করেন। আদালত তা মঞ্জুর করে পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ২৫ সেপ্টেম্বর ধার্য করেন।
২০২৪ সাল
আদালতে হাজির না হয়ে পরপর তিন দফা সাক্ষ্যগ্রহণ পেছানোর আবেদন করায় আসামিপক্ষকে এক হাজার টাকা দেওয়ার জন্য চিত্রনায়িকা পরীমনিকে আদালত থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
২৪ জুন
নাসির উদ্দিন মাহমুদের করা সেই পাল্টা মামলায় জামিন নিতে আদালতে যান। বাদী আদালতে অনুপস্থিত থাকলেও পরীমনির প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেন এবং জামিনে আপত্তি জানান না। আদালত জামিন মঞ্জুর করেন।
২০২৫ সাল
২৭ জানুয়ারি
আদালতে উপস্থিত না হওয়ায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানার পরিপ্রেক্ষিতে পরীমনি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। হাস্যোজ্জ্বলভাবে আদালতে যান এবং জামিন পান। আদালতের বাইরে তার ছবি ও ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। পরীমনি সংবাদমাধ্যমে জানান, ‘আমি খুব খুশি যে আপনাদের এত ভালোবাসা পেয়েছি। আমি বিশ্বাস করি, আদালতের কাছ থেকে ন্যায়বিচার পাব। আজ আমি আদালতের কাছ থেকে ন্যায়বিচার পেয়েছি।’
২৬ মে
সর্বশেষ ২৬ মে বোট ক্লাব মামলায় সাক্ষ্য দিতে আবার আদালতে যান। প্রচণ্ড গরম ও দীর্ঘ সময় অপেক্ষার কারণে পরীমনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। আদালত সাক্ষ্যগ্রহণ স্থগিত করেন এবং পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করেন।
পরীমনির দায়ের করা এবং তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাগুলো এখনও রয়েছে মাঝপর্যায়ে। বিজ্ঞ আদালত মামলাগুলোর ফলাফল নির্ধারন করবেন। তবে তার আগপর্যন্ত দর্শকেরা রুপালি পর্দার চেয়ে এই অভিনেত্রীকে আদালতের প্রাঙ্গনেই বেশি দেখবেন বলে মনে করছেন অনেকে।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment