×

শিলাইদহকে যেভাবে বদলে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ

আজ পঁচিশে বৈশাখ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গভীর। কুষ্টিয়ার শিলাইদহে ছিল তাঁর কুঠিবাড়ি। জমিদারি দেখভালের সূত্রে এখানে এসে এ অঞ্চলকেই বদলে দিয়েছিলেন তিনি। বইপত্র ঘেঁটে জানাচ্ছেন গৌতম কে শুভ

‘আমার যৌবন ও প্রৌঢ় বয়সের সাহিত্যরস সাধনার তীর্থস্থান ছিল পদ্মা-প্রবাহ-চুম্বিত শিলাইদহ পল্লীতে’ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই লেখায় শুধু আবেগ নয়, ছিল এক গহিন সত্যের স্বীকারোক্তি। কুষ্টিয়ার শিলাইদহ কুঠিবাড়ির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক শুধুই ঐতিহাসিক নয়। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকেও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি এখানে এসেছিলেন জমিদারির দায়িত্ব পালনের জন্য, কিন্তু ধীরে ধীরে এই জায়গাটি হয়ে ওঠে তাঁর সাহিত্যচর্চা এবং সমাজ ভাবনা গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।

শিলাইদহই যেমন তাঁর লেখকজীবনের অনেকগুলি শ্রেষ্ঠ রচনা ও উপলব্ধির প্রেক্ষাপট, আবার এটি ছিল এক পরীক্ষাগার। যেখানে একজন তরুণ জমিদার পল্লীজীবনের বাস্তবতা দেখলেন, বুঝলেন এবং সংগঠক রবীন্দ্রনাথ ও সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ হিসেবে ব্যক্তিজীবনে প্রয়োগ করলেন।

রবীন্দ্রনাথ আসার আগে শিলাইদহ যেমন ছিল

শিলাইদহ সেই সময়ে নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া মহকুমার অধীনে ছিল। রবীন্দ্রনাথ জমিদারি নেওয়ার আগে এই এলাকা ছিল সামাজিকভাবে বেশ থেমে থাকা। খুব একটা পরিবর্তন বা অগ্রগতি হচ্ছিল না। জমিদারি কাঠামোর মধ্যে আমলাদের অসহযোগিতা এবং দুর্নীতি ছিল চোখে লাগার মতো। প্রশাসনিক জটিলতাও ছিল। প্রজার সঙ্গে জমিদারের সম্পর্ক ছিল শুধুই কর নেওয়ার; কোনো মানবিক যোগাযোগ ছিল না।

শিলাইদহ অঞ্চলে আগে থেকেই নানা হিন্দু বর্ণ-পেশার মানুষের বাস ছিল। হিন্দু-মুসলমান আলাদা আলাদা পাড়ায় থাকতেন। তাদের মধ্যে সম্পর্ক বেশ ভালো ছিল। বিভিন্ন কারণে রবীন্দ্রনাথের সময় থেকে এই এলাকা মুসলমানপ্রধান হয়ে ওঠে। সেখানে নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বালিকা বিদ্যালয়, ডাকঘর, মন্দির, দরগা, ডাক্তার-কবিরাজের চেম্বার; সবই ছিল। পদ্মার ইলিশ, নদীচরের মটর-কলাই আর পাকা কলার বেশ নামডাক ছিল। শখের গ্রাম্য যাত্রাদল থেকে শুরু করে কীর্তন-বাউলগানের চর্চাও হত কিছুটা। পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় এসবের নতুন প্রাণ দিয়েছিলেন।

শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের দিনিলিপি

শিলাইদহে তাঁর রুটিন ছিল বেশ গোছানো। সেখানে ভাববাদী ও বাস্তববাদী জীবনের সমন্বয় করতেন। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন। সকালের খাওয়া শেষে একা বেরিয়ে পড়তেন মাঠে, সঙ্গে একজন বরকন্দাজ (বন্দুকধারী সেপাই) দূরে দূরে থাকতেন। পথে প্রজাদের ‘সেলাম হুজুর’ পেয়ে গল্পে মাততেন। জানতে চাইতেন তাদের সুখ-দুঃখের কথা। গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ফিরতেন কুঠিবাড়িতে।

এরপর শুরু করতেন জমিদারির কাজ। আমলা, প্রজা, মামলা-মোকদ্দমা, নথিপত্র, অতিথির সঙ্গে আলাপ; সবকিছুই করতেন দায়িত্ব নিয়ে। এ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘প্রজারা আমাকে দর্শন করতে আসত, তাদের জন্য সর্বদাই আমার দ্বার ছিল অবারিত—সন্ধ্যা হোক, রাত্রি হোক, তাদের কোনো মানা ছিল না।‘

এরপর জমিদারির কাজ শেষ করে ১১টার মধ্যে দুপুরের খাবার খেয়ে লিখতে বসতেন। মাঝেমধ্যে গ্রামভ্রমণ, কখনো পদ্মার চরে কিংবা ঘাটের নির্জনতায় নৌকায় একান্তে সময় কাটানো। রাতে আবার লেখালেখি। বিশ্রাম তাঁর জীবনে বিশেষ কিছু ছিল না।

শিলাইদহ অঞ্চলে রবীন্দ্রনাথের সক্রিয়তা

শিলাইদহ আসার আগেই রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন, জমিদারি ব্যবস্থায় অনেক দুর্বলতা আছে। তাঁর পূর্বপুরুষদের জমিদারিতে অভিজ্ঞতার অভাব আর দায়িত্বের ঘাটতিতে প্রজারা অনেক কষ্ট পেতেন। কুমারখালী থেকে প্রকাশিত কাঙাল হরিনাথের ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকায় সেই অভিযোগগুলো প্রায়ই তোলা হত। বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এ ব্যাপারে তাঁর মনঃকষ্টের কথা তরুণ রবীন্দ্রনাথকে শুনিয়েছিলেন। একই সঙ্গে বসে জমিদারির ব্যাপারে ভাবতেন। রবীন্দ্রনাথ সেই পথেই এগিয়ে যান।

তিনি জমিদারির কিছু পুরোনো নিয়ম ভেঙে নতুন ব্যবস্থার কথা ভেবেছিলেন। যেমন আগের ৯টি কাছারিকে ভাগ করে ৩টি নতুন বিভাগীয় কাছারি তৈরি করেন। কারণ সদর কাছারি, নয়টি ডিহি কাছারি, কৃষিব্যাংক, মামলা, আমলা, উকিল; সব মিলিয়ে একটি জটিল অবস্থা। প্রজারা সহজে সেবা পাচ্ছিলেন না। আবার এখানে অর্থ, ক্ষমতা আর দায়িত্বেরও অপব্যবহার হচ্ছিল।

এ ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্ষমতা শুধু জমিদারের হাতে না রেখে স্থানীয়ভাবে কিছুটা ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। মানুষ একে বলত ‘ডিভিশন সিস্টেম’ বা ‘মণ্ডলী-প্রথা’। আসলে এটা ছিল ক্ষমতা ভাগ করে দেওয়ার বা বিকেন্দ্রীকরণের এক নতুন প্রয়াস। এর ফলে জমিদার রবীন্দ্রনাথ একজন দূরের মানুষ হয়ে থাকেননি, বরং প্রজাদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করা একজন জমিদারে পরিণত হয়েছিলেন।

তিনি দেখতেন, বুঝতেন, সমাজকে জানতেন। জমিদার হিসেবে এটিই তাঁর পদ্ধতি ছিল। জমিদারি কাজ ও লেখালেখির ফাঁকে সময় করে শিলাইদহতে বেশকিছু সংগঠনমূলক কাজ হাতে নিয়েছিলেন। গ্রামের উন্নয়নের জন্য ‘পল্লীসমাজ’-এর গঠন পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন। এর অংশ হিসেবে ‘মহর্ষি দাতব্য চিকিৎসালয়’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রস্তাবনায় বলা ছিল, ‘একটি চিকিৎসক ও ঔষধালয় স্থাপন করা এবং অপারগ অনাথ ব্যক্তিবর্গের নিমিত্তে ঔষধ, পথ্য, সেবা ও সৎকারের ব্যবস্থা করা।‘ আবার রবীন্দ্রনাথ শুধু চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা কিংবা চিকিৎসাবিষয়ক প্রস্তাব পাশ করেই দায়িত্ব শেষ করেননি, নিজেও ‘হোমিও’ এবং ‘বায়োকেমি’ চিকিৎসায় অভিজ্ঞ থাকায় গ্রামবাসীদের চিকিৎসা সেবাও দিয়েছেন।

যেখানে গ্রামোন্নয়নের কোনো ভালো উদ্যোগের খবর পেতেন, রবীন্দ্রনাথ সেখানেই ছুটতেন। একবার জানতে পেরেছিলেন সমবায় সমিতির মাধ্যমে কয়েকজন ডাক্তার গ্রামাঞ্চলে ম্যালেরিয়ার মত রোগের চিকিৎসা করছে। তাদের সহায়তা ও পরামর্শে শিলাইদহে একটি ‘রেজিস্টার্ড সোসাইটি’ গড়ে তুলেছিলেন। তখন রবীন্দ্রনাথ আর শিলাইদহে থাকতেন না, তবুও গ্রামের উন্নয়নের কথা তিনি ভোলেননি। নিজ খরচে সমিতির ৪জনকে শ্রীনিকেতনে নিয়ে গিয়ে হস্তশিল্প শেখার ব্যবস্থা করেছিলেন। আবার সেখান থেকে ২জনকে শিলাইদহে পাঠিয়েছিলেন যাতে সবাই মিলে সমিতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন।

তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সহযোগিতায় শিলাইদহ সদর কাছারিতে তাঁতের কারখানা স্থাপন করেছিলেন। কুষ্টিয়া শহরে ‘ট্যাগোর অ্যান্ড কোং’ নামে রেজিস্ট্রি করা কোম্পানি করেছিলেন এই অঞ্চলের প্রধান দুটি অর্থকরী ফসল পাট ও আখ চাষিদের জন্য। কুমারখালীর পান্টিতে সুতা ও কাপড়ের হাট প্রতিষ্ঠা করে চেষ্টা করেছিলেন এই অঞ্চলের বস্ত্রশিল্পকে বিস্তৃত করতে। তখনও কিন্তু কুষ্টিয়ায় বিখ্যাত সেই মোহিনী মিল তৈরি হয়নি।

কৃষি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা ছিল। এই ভাবনার প্রেক্ষাপটও শিলাইদহ। রবীন্দ্রনাথের ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমেরিকায় আধুনিক পদ্ধতিতে কৃষিবিদ্যা শিখে দেশে ফিরে আসার পর শিলাইদহ কুঠিবাড়ির উত্তর ও পশ্চিম পাশে ৮০ বিঘা জমি নিয়ে এক বিশেষ খামার তৈরি করেন। এখানে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ করা হতো—নতুন ফসলের পরীক্ষা, সার তৈরি, আধুনিক  লাঙ্গল ও কৃষিযন্ত্র ব্যবহার করে কৃষি-গবেষণা চলত। জমিতে পানি দেওয়ার জন্য দুটি পুকুর থেকে পাম্পের সাহায্যে সেচের ব্যবস্থা ছিল। আর পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী সেখানে একটি বালিকা বিদ্যালয়ও চালাতেন।

বিশেষ করে মুসলমান প্রজাদের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ব্যতিক্রমী, যাদের অবস্থান ছিল সমাজের নিচু স্তরে এবং যারা সাধারণত বরকন্দাজ বা নিম্নপদস্থ কর্মচারী। তিনি তাঁদের মধ্যে স্বল্প শিক্ষিতদেরকেও কাজ শিখিয়ে মুহুরি, আমিন ও তহশিলদার পদে নিয়োগের ব্যবস্থা করেন। ছোটবড় চারটি মক্তব-মাদ্রাসা গড়ে তোলেন, যেখানে নিয়মিত অনুদান দিতেন।

শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের সক্রিয়তা নিয়ে ঠাকুর এস্টেটের কর্মচারী ও শিলাইদহের বাসিন্দা লেখক শ্রী শচীন্দ্রনাথ অধিকারীর শিলাইদহ রবীন্দ্রনাথ বইতে জানা যায়, ‘এই জমিদারিতে অনেক সংগঠনমূলক কাজ হল। শালিসি-বিচার প্রবর্তনের ফলে প্রজাসাধারণের অভ্যাসগত অনেক মামলা-মোকদ্দমার আপস-নিষ্পত্তি হওয়ায় ঐ অঞ্চলের সবাই উপকৃত হল। শিলাইদহ গ্রামের মধ্যে দুটি প্রধান রাস্তা, গোপীনাথ মন্দিরের সংস্কার, দাতব্য চিকিৎসালয়, কুষ্টিয়া-শিলাইদহ রাস্তা ইত্যাদি শিলাইদহের চেহারা পাল্টে দিল। জানিপুরে গোরাই নদীর তীরে বিরাট গঞ্জ গড়ে উঠল, পান্টির সুতাহাটা, গোহাটা ইত্যাদি জেকে উঠল, ব্যাপকভাবে তাঁতবস্ত্র তৈরি হতে লাগল, শিলাইদহে দুবার বিরাট মেলা বসল, কয়েকটি স্কুল-মক্তব-মাদ্রাসা স্থাপিত হল গ্রাম ও চর অঞ্চলে’।

সাংস্কৃতিক বিপ্লব: নাট্যসমাজ থেকে বাউলগান

শিলাইদহে আগে থেকেই অপেশাদার যাত্রাদল ছিল। রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে সেটা থেকেই নাটকের দল তৈরি হয়েছিল। আবার একবার রাখীবন্ধন উৎসবের সময় গ্রামের তরুণেরা নতুন থিয়েটারের দল গড়বার জন্য তাঁর কাছে গেলে তিনি কাছারিতে পড়ে থাকা ভাঙাচোরা মঞ্চ মেরামত করে বাকি সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তখন বঙ্গলক্ষ্মী কাপড়ের কলের খুব খ্যাতি ছিল। তিনিই গ্রামের থিয়েটার দলের নামকরণ করেছিলেন ‘বঙ্গলক্ষ্মী নাট্যসমাজ’। এই দলটি ওই অঞ্চলে নাট্যচর্চায় ভালো ভুমিকা রেখেছিলো।

তাঁর সময়ে শিলাইদহের লালন ফকিরের বাউলগান, পুণ্যাহ (খাজনা আদায়ের প্রতীকী অনুষ্ঠান), গোপীনাথদেবের পালপার্বণ, খোকসার জানিপুরের বিখ্যাত শিবু সাহার কীর্তন, মুকুন্দ মালাকারের কীর্তন, হরির লুট কীর্তন, আমীনশার ভাসানযাত্রা, গগণ হরকরার ‘সখীসংবাদের’ দলের গান, অষ্টসখীর গানের আসর বসতো। আবার প্রায়ই বৈশাখ ও কার্তিক মাসে নগরসংকীর্তন বের হত এবং সেই গান কুঠিবাড়িতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে শুনিয়ে শেষ হতো।

নাটক, কীর্তন, বাউলগান, রাখীবন্ধন উৎসব; সবকিছুর মধ্যে দিয়ে শিলাইদহ হয়ে উঠেছিল ওই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র। এসব এক সুতোয় গাঁথা হয়েছিল তাঁর উদ্যোগেই।

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment