×

ধুলো মাখা শক্ত রুটি হয়ে উঠেছিল সিপাহী বিদ্রোহের প্রতীক

একটা রুটি। ধুলো মাখা, শক্ত, বিস্বাদ। টেবিলের উপর পড়ে আছে চুপচাপ। কেউ খায়নি, কেউ ছুঁয়েও দেখেনি। অথচ সেই রুটি নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত ব্রিটিশ অফিসাররা। কেন? কারণ, সেই নিরীহ রুটিই হয়ে উঠেছে এক অদৃশ্য বিদ্রোহের দূত। 

সালটা ১৭৫৭। ফ্রেব্রুয়ারি। প্রতিদিনের মতোই একজন উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মকর্তা সকালবেলা কার্যালয়ে এলেন। টেবিলে আবিষ্কার করেন এক টুকরো ধুলোমাখা রুটি। সকালবেলা এমন অদ্ভুত কাণ্ড দেখে তিনি অবাক হন। এই কর্মকর্তা ছিলেন মাথুরার ম্যাজিস্ট্রেট মার্ক থ্রনহিল। আচমকা রুটির এই আগমণকে ব্রিটিশ প্রশাসনের নজরে আনেন তিনি। খোঁজ নিয়ে জানা যায় রুটিটি এনেছেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। এবং তিনি এটি পেয়েছেন গ্রামের এক চৌকিদারের কাছে থেকে। চৌকিদার জানান রুটিটি এসেছিল জঙ্গল থেকে।

মার্ক জানতে পারেন, দক্ষিনে নর্মদা নদীর তীরবর্তী এলাকা থেকে উত্তরে নেপালের সীমানা পর্যন্ত কয়েকশত মাইল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে এই রুটি। মহামারির মতো এই রুটি ছড়িয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছিল মাত্র এক রাতেই। এই রুটি পরীক্ষা করে তাতে অস্বাভাবিক কিছু পাওয়া যায়নি। রুটিগুলো আকারেও ছিল স্বাভাবিক। 

ধীরে ধীরে এই রুটি ছড়িয়ে পড়ছিল সমগ্র ভারতবর্ষে। অচিরেই ব্রিটিশ প্রশাসনের ঘুম উড়িয়ে দেয় সামান্য এই রুটি। 

যেহেতু রুটি বিতরণ কোনো অপরাধ নয়, তাই এ কারণে কাউকে গ্রেফতারও করা যাচ্ছিলো না। কিন্তু সন্দেহ করা হচ্ছিলো এই রুটি মধ্য দিয়ে ছড়ানো হচ্ছে কোনো গোপন বার্তা।

গতকাল ছিল ১০ মে। এদিন সিপাহী বিদ্রোহের ১৬৮ বছর পূর্ণ হয়। ১৮৫৭ সালের এই দিনে ভারতের মাটিতে জ্বলেছিল প্রতিরোধের প্রথম শিখা। একে কেউ কেউ বলেন ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম।’ ইতিহাসের গভীরে এর তাৎপর্য অমোঘ।

আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এই রুটির মধ্য দিয়ে রোপণ করা হয়েছিল ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ। সিপাহী বিদ্রোহের প্রস্তুতি হিসেবে বেড়ে উঠছিলো এই রুটি কাহিনী।  

১৮৫৭ সালের মে মাসে মিরাট ক্যান্টনমেন্ট থেকে যে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল, তা শুধু ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে এক সামরিক বিদ্রোহ ছিল না। ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের অন্যায়, শোষণ, অর্থনৈতিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে উপমহাদেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের এক অভূতপূর্ব ঐক্য, এক সম্মিলিত প্রতিবাদ। তখন সিপাহী, রাজা-জমিদার, কৃষক, শিল্পী, মুসলিম-হিন্দু—সবাই মিলে এক সুরে আওয়াজ তুলেছিল, ‘এ শৃঙ্খল মানি না।’

বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল বহুদিনের ক্ষোভ থেকে। সেই ক্ষোভের আগুনে নতুন করে ঘি ঢেলে দেয় এনফিল্ড রাইফেলের কার্তুজে গরু-শূকরের চর্বি ব্যবহার। যা চরম আঘাত হেনেছিল হিন্দু ও মুসলিম, দুই ধর্মের সিপাহীদেরই ধর্মীয় বিশ্বাসে।  যা পুরনো ক্ষোভকে বিস্ফোরণ রুপ দেয়ার জন্য যুগিয়েছিল প্রয়োজনীয় স্ফুলিঙ্গ।

তবে এই বিক্ষোভের শিকড় শুধু ধর্মীয় ছিল না; জমির কর বৃদ্ধি, স্থানীয় শাসকদের ক্ষমতা হরণ, গ্রামীণ অর্থনীতি ধ্বংস, এমন নানা কারণে সাধারণ মানুষও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। 

মিরাট থেকে দিল্লি, কানপুর, লখনউ, ঝাঁসি, গোয়ালিয়র—ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছিল এই বিদ্রোহ। ৮৫ জন সিপাহীর মৃত্যুদণ্ড, বাহাদুর শাহ জাফরকে প্রতীকী সম্রাট হিসেবে ঘোষণা, রানি লক্ষ্মীবাঈ, তাতিয়া টোপের মতো সাহসী নেতাদের নেতৃত্ব—সব মিলিয়ে রচিত হয়েছিল এক অনন্য সংগ্রামের ইতিহাস।

১৮৫৮ সালের ২০ জুন গোয়ালিয়রে বিদ্রোহীদের নির্মমভাবে দমন করার মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত নিষ্ঠুরতার পরিচয় দেয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। নিহত হয় বহু নিরপরাধ মানুষ। তবে এই বিদ্রোহ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটিয়ে ভারত সরাসরি ব্রিটেনের রাজতন্ত্রের পথ সুগম করে দেয়।

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এর প্রতিটি পদক্ষেপ ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। এই বিদ্রোহ দেখিয়ে দিয়েছিল, বৈষম্য, শোষণ আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে ভারতবাসী এক হতে পারে। রুটি থেকে শুরু হওয়া সেই নীরব বার্তা পরিণত হয়েছিল বজ্রকণ্ঠের চিৎকারে। সেই চেষ্টাই পরবর্তী সময়ে গড়ে দিয়েছিল সংগঠিত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ভিত্তি, স্বপ্ন দেখিয়েছিল এক স্বাধীন ভারতের।

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment