ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে কেন ফিরে আসে মান্টোর ‘ঠান্ডা গোশত’
আজ ১১ মে, উর্দু সাহিত্যের অন্যতম কথাসাহিত্যিক সাদত হাসান মান্টোর জন্মদিন। ১৯৪৭ সালের দাঙ্গায় পাকিস্তানে চলে যেতে হয়েছিল তাঁকে। তীব্র সংগ্রামমুখর জীবন ছিল তাঁর। চলমান পাকিস্তান ভারতের সংঘাতের মধ্যে আবারও কীভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন তিনি? কীভাবেই বা তাঁর লেখা ‘ঠান্ডা গোশত’ ছড়িয়ে আছে কাশ্মীরের বিপন্ন ভূমিতে? লিখেছেন শতাব্দীকা ঊর্মি
‘এখানে সমাধি তলে শুয়ে আছে মান্টো আর তাঁর বুকে সমাহিত আছে গল্প বলার সব রহস্য, সব কৌশল।’ একটা কবরের ফলকে এই কথাগুলো খোদাই করে লেখা। কবরটা একজন সাহিত্যিকের। সেই সাহিত্যিকের নাম সাদাত হোসেন মান্টো। ১৯১২ সালের ১১ মে পাঞ্জাবের লুধিয়ানায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। আজ কবরে শুয়ে থাকা সেই সাহিত্যিকের জন্মদিন।
মান্টো, যাঁর কলমকে থামতে পারেনি ক্ষুধা, দারিদ্র্য, জেল কিংবা জরিমানা। ১৯৪৭ সালের ভারত-ভাগের দাঙ্গায় এই ভাষাশিল্পী হয়ে উঠেছিলেন বিভীষিকার বিপরীতে দাঁড়ানো নির্ভীকতার প্রতীক।
দাঙ্গায় তাঁকে চলে যেতে হয়েছিল ভারত থেকে পাকিস্তানে। তাঁর লেখায় ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের পরিণতিতে যে হিংসা ও নৃশংসতা দেখা দেয়, তা কেবলই ঐতিহাসিক দলিল নয়, আজকের পাক-ভারত সংঘাতে তা নিত্য প্রতিফলিত।
দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে রক্তাক্ত ভূখণ্ডগুলোর একটি কাশ্মীর। ইতিহাস, রাজনীতি ও সহিংসতায় দগ্ধ এই ভূখণ্ডে মানুষ হারিয়েছে ঘর, পরিবার, স্বপ্ন ও এমনকি বাস্তবতাও। ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব, সাম্প্রদায়িকতা ও রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের বলি হয়ে এই অঞ্চলের বাস্তবতা যেন বারবার ফিরে আসে সাদত হাসান মান্টোর গল্পে—বিশেষত তাঁর গল্প ‘ঠান্ডা গোশত’-এ।

কাশ্মীর ও ‘ঠান্ডা গোশত’
‘ঠান্ডা গোশত’ গল্পে আমরা দেখি ঈশ্বর সিং নামের এক শিখ পুরুষ দাঙ্গার মধ্যে ছয়জনকে খুন করে। এছাড়া এক সুন্দরী মুসলমান নারীকেও তুলে নিয়ে যায় ধর্ষণের উদ্দেশ্যে। কিন্তু যখন সেই নারীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে যায়, তখন আবিষ্কার করে, মেয়েটি আসলে মৃত, তার শরীর ঠান্ডা, প্রাণহীন। তৎকালীন বাস্তবতায় এই ভয়াবহতা কোনো কাল্পনিক রোমাঞ্চ ছিল না। ছিল খোলামেলা এক বাস্তবতা, যা দাঙ্গার সময়ের সবচেয়ে স্বচ্ছ দলিল।
বর্তমান পাক ভারত যুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন, রাজনৈতিক ভিন্নমতের দমন যেভাবে সংঘটিত হচ্ছে, মান্টোর গল্প সেখানেও প্রাসঙ্গিক।
কাশ্মীর উপত্যকার বহু সংঘাতের ঘটনা ‘ঠান্ডা গোশত’-এর সেই মৃত মেয়েটির মতোই নীরব হয়ে পড়ে আছে—ঠান্ডা, নিশ্চুপ, নিষ্প্রাণ। ভারত ও পাকিস্তানের নেতৃত্বের কূটনৈতিক ব্যর্থতা, কাশ্মীরি জনগণের ইচ্ছার প্রতি উপেক্ষা জন্ম দিচ্ছে কেবল ঘৃণা ও বিভাজনের।
উগ্রপন্থা ও জাতিগত ঘৃণার বিরুদ্ধে মান্টোর দৃঢ়তা সর্বজনবিদিত। মান্টোর দেখিয়ে যাওয়া সেই বিভেদহীনতার পথ কাশ্মীর সমস্যার কেন্দ্রে থাকা হয়তো উচিতই ছিল, কিন্তু বাস্তবে তা অনুপস্থিত।
মান্টোর বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ ছিল, কেননা তিনি লজ্জার মুখোশ খুলে সত্য দেখাতে চাইতেন। কাশ্মীরের বাস্তবতা দেখলে বোঝা যায়, সত্য বলার জন্য যে সাহস দরকার, তা মান্টো দেখিয়েছিলেন।
আজ যখন কাশ্মীরি শিশুদের চোখে ভয়, নারীদের দেহে নির্যাতনের ছাপ আর পুরুষদের গলায় ক্ষোভের দগদগে ঘা, তখন মান্টোকে নতুন করে পড়া জরুরি হয়ে পড়ে। ‘ঠান্ডা গোশত’ যেন কেবল একটি গল্প নয়, উপমহাদেশের অমীমাংসিত অঞ্চলগুলোর বাস্তবতার নিষ্ঠুর দলিল।
কাশ্মীর নিয়ে ভারত পাকিস্তান সংকট কোনো একক ধর্মীয় বা জাতিগত নয়, এ এক মানবতার সংকট। আজকের কাশ্মীরে ‘ঠান্ডা গোশত’ স্মরণ করিয়ে দেয়, যদি আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নিই, তবে আমরা কেবল মানচিত্রের লোভে মৃতদেহের সঙ্গেই সহবাস করতে শিখবো। যার ভেতর নেই কোনো ভালোবাসার কোমলতা, কোনো প্রেমের উত্তাপ।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment