মমতাজ : বাউল থেকে রাজনীতি, এখন কারাবন্দী
ছিলেন বাউলশিল্পী। গানে গানে মানুষকে আনন্দ দিয়ে মধ্যরাতে মঞ্চ ছেড়ে নেমে আসা এক সময়ে ছিল নিত্যদিনের কাজ। পরে রাজনীতিতে নাম লিখিয়ে সেই মমতাজকেই কিনা মধ্যরাতে পুলিশের সঙ্গে যেতে হলো থানায়। বিস্তারিত জানাচ্ছেন শতাব্দীকা ঊর্মি
জনপ্রিয় বাউল শিল্পী মমতাজ বেগমকে গতকাল রাত ১২টার দিকে ধানমন্ডি থেকে আটক করেন পুলিশ। বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান।
তালেবুর রহমান জানান, মমতাজের বিরুদ্ধে হত্যা মামলাসহ একাধিক অভিযোগে দায়ের হওয়া একাধিক মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকায় তাকে আটক করা হয়েছে। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।
লোকজ আবেগের এক দৃঢ় কণ্ঠস্বর
বাংলাদেশের লোকসংগীত অঙ্গনের অন্যতম উজ্জ্বল নাম মমতাজ বেগম। ‘ফোক কুইন’ নামে খ্যাত এই শিল্পীর সংগীতজীবনের সূচনা হয়েছিল মানিকগঞ্জের এক প্রত্যন্ত গ্রামে, ধলেশ্বরী নদীর তীরে। সংগীতের হাতেখড়ি হয়েছিল পারিবারিক পরিবেশে—তাঁর বাবা ছিলেন একজন বাউল গায়ক, যিনি গ্রামীণ পালাগানের মধ্য দিয়ে জীবনের নানা বাস্তবতা প্রকাশ করতেন। বাবার সঙ্গেই মঞ্চে ওঠা, মানুষের মাঝে গান গাওয়া, আর সেই ছোটবেলার অভিজ্ঞতাই গড়ে দেয় মমতাজের সংগীতচর্চার ভিত।
মমতাজের কণ্ঠে ছিল খাঁটি আবেগ—যা সহজেই ছুঁয়ে যেত শ্রোতার মন। তাঁর গানে ধরা পড়ত গ্রামীণ জীবনের প্রেম, বিরহ, সংগ্রাম ও নারীর অন্তর্দ্বন্দ্ব। নব্বইয়ের দশকে তাঁর জনপ্রিয়তা চরমে পৌঁছে যায়। ‘ফাইট্টা যায়’, ‘মরার কোকিলে’, ‘রসিয়া বন্ধু’—এসব গান শুধু গ্রামবাংলা নয়, শহরের ক্যাসেটের দোকানেও ছিল বিক্রির শীর্ষে। চায়ের দোকানে, রিকশার রেডিওতে, গ্রামীণ মেলায়—সবখানেই বাজত মমতাজের গান।
তাঁর কণ্ঠে বাউল গান হয়ে উঠেছিল লোকজ হৃদয়ের প্রতিধ্বনি। লোকসংগীতের একধরনের ভাঙা, বাধা-ধরা বাস্তবতাকে তিনি তুলে ধরতেন অকপটে। এই সরলতা ও আন্তরিকতাই তাকে বানিয়ে তোলে গণমানুষের শিল্পী। মমতাজের সংগীত শুধু বিনোদনের উপকরণ নয়—এটি হয়ে ওঠে একটি শ্রেণির জীবন ও অনুভূতির প্রতিধ্বনি।
লোকসংগীতকে আধুনিক ক্যাসেট শিল্প ও মিডিয়ায় প্রবেশ করিয়ে মমতাজ বেগম হয়ে ওঠেন এক লোকসংগীতে আইকন—যার শেকড় গ্রামে, কণ্ঠে যন্ত্রণার কথা, আর চোখে হাজারো মানুষের ভালোবাসা।
জনপ্রিয়তার পর্ব
মমতাজ বেগমের গানের মূল আকর্ষণ ছিল তার সরলতা ও আবেগময় প্রকাশভঙ্গি। তার গানে উঠে আসত গ্রামীণ নারীর প্রেম-বিরহ, দাম্পত্য টানাপোড়েন, অর্থনৈতিক অসহায়ত্ব এবং শরীরী অনুভূতির মতো বিষয়—যা সে সময় মূলধারার গানে সহজে প্রকাশিত হতো না। খোলামেলা ও অকপট ভঙ্গিই তাকে সাধারণ মানুষের কাছে আপন করে তোলে।
নব্বইয়ের দশকে যখন অডিও ক্যাসেট শিল্প বাংলাদেশের সংগীত জগতে রাজত্ব করছিল, তখন মমতাজ বেগম হয়ে ওঠেন সবচেয়ে বিক্রিত শিল্পীদের একজন। তার অনেক অ্যালবাম একসঙ্গে লক্ষাধিক কপি বিক্রি হয়—যা তখনকার সময়ে বিরল ঘটনা ছিল। ‘ফাইট্টা যায়, ‘রসিয়া বন্ধু’, ‘আমারে ভুলাইবা কেমনে’—এই সব গান ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়। তার কণ্ঠ ছিল সহজ, মাটির কাছাকাছি, যে কণ্ঠ সাধারণ মানুষের জীবনের কথা গাইত, বিনোদন দিতো, আবার প্রশ্নও তুলতো।
এই জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে তাকে নিয়ে যায় বাণিজ্যিক সাফল্যের নতুন স্তরে। দেশের বিভিন্ন জেলায় স্টেজ শোতে উপচে পড়া ভিড় দেখা যেত মমতাজকে ঘিরে। বিদেশেও প্রবাসী বাঙালিদের কাছে তার গান ছিল আবেগের অংশ—বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার মঞ্চে তার নিয়মিত উপস্থিতি ছিল। এইতো গতবছরেও নিউইয়র্কে কনসার্ট করেছেন তিনি। এখনো ইউটিউবে সার্চ করলে সেই কন্সার্টের ভিডিও ক্লিপ পাওয়া যায়। তিনি হয়ে ওঠেন এমন এক কণ্ঠ, যাকে শুনলে প্রবাসীরা বাংলাদেশের গ্রাম, মাঠ, নদী আর সম্পর্কের ঘ্রাণ পেত।
মিডিয়ার দুনিয়ায়ও তার প্রবেশ ছিল দাপুটে। টেলিভিশন টকশো, গানের অনুষ্ঠান, চলচ্চিত্রে গান, বিজ্ঞাপন এমনকি নাট্যজগতেও তার কণ্ঠস্বর ব্যবহার হয়েছে। পৃষ্ঠপোষকদের কাছে মমতাজ হয়ে ওঠেন যেন এক ‘লোকজ ব্র্যান্ড’, যার কণ্ঠস্বর ছিল মাটির, কিন্তু সম্ভাবনা ছিল আন্তর্জাতিক।
এইসব মিলিয়ে মমতাজের জনপ্রিয়তা কোনো ক্ষণিকের উজ্জ্বলতা ছিল না—বরং একটি দীর্ঘমেয়াদি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়, যেখানে তার গান হয়ে ওঠে গ্রামের মানুষের বেদনার ভাষ্য, আবার শহরের শ্রোতার কাছে এক নতুন আবিষ্কার।
রাজনীতির মাঠে প্রবেশ
২০০৯ সালে জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য হওয়ার মধ্য দিয়ে রাজনীতির মাঠে প্রবেশ ঘটে মমতাজের। এরপর ২০১৪ সালে অবশ্য ভোটের মাধ্যমে এমপি হয়েছিলেন। সেবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে মানিকগঞ্জ-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মমতাজ বেগম। এর মাধ্যমে তিনি শিল্পী থেকে রূপ নেন একজন রাজনৈতিক নেতায়। এমপি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডেও যুক্ত হন। ২০১৮ সালে নৌকার মনোনয়নে মানিকগঞ্জ-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে ২০২৪ সালে নৌকা মনোনয়ন পেয়েও ভোটের হেরে যান তিনি।
তবে জনপ্রিয়তার পাশাপাশি রাজনৈতিক কার্যক্রম ঘিরে বিভিন্ন সময়ে প্রভাববিস্তার, দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগ উঠতে থাকে। এসব অভিযোগ নিয়ে দুদক ও অন্যান্য তদন্ত সংস্থা অনুসন্ধান চালায়।
সম্প্রতি মমতাজের গ্রেফতারের ঘটনায় সাংস্কৃতিক অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেকেই বিষয়টিকে আইনের প্রক্রিয়া হিসেবে দেখলেও অনেকে বলছেন, একজন শিল্পীর এমন পরিণতি অত্যন্ত দুঃখজনক।
শিল্পীর জীবন থেকে বন্দি জীবন
কারাগারে পাঠানোর পরপরই আলোচনায় আসে—একজন শিল্পী যিনি একসময় গানে গানে মানুষের মন জয় করেছিলেন, তিনি কীভাবে এই পরিস্থিতিতে এলেন? শিল্পজীবন থেকে রাজনীতির পথে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই যেন তার কণ্ঠস্বর ফিকে হতে শুরু করেছিল। রাজনীতির চাপে, প্রশাসনিক কাঠামোর জালে, এবং শেষমেশ আইনের মুখোমুখি হয়ে আজ তার সেই কণ্ঠ নিরব।
মমতাজ বেগমের গ্রেপ্তারের ঘটনা শুধু একজন শিল্পীর আইনি সমস্যায় পড়ার কাহিনি নয়। এটি একটি বড় প্রশ্নের জন্ম দেয়—রাজনীতি ও জনপ্রিয়তা যখন একসঙ্গে এগোয়, তখন একটি শিল্পীসত্তা কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়? লোকগানের সেই মাটির কণ্ঠ, যিনি একসময় ‘রসের বাইনা’ গেয়ে মানুষের হৃদয় জয় করেছিলেন, আজ তাকেই দেখা যাচ্ছে বিচার ব্যবস্থার কাঠগড়ায়।
রাজধানীর মিরপুর থানায় দায়ের করা সাগর হত্যা মামলায় মমতাজকে আজ আদালতে হাজির করে সাত দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করেছে পুলিশ। পরবর্তী শুনানিতে তার জামিন ও মামলার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে আদালত।
এক সময়ের বাউল শিল্পী থেকে হয়েছিলেন সংসদ সদস্য, সেখান থেকে আজ তাঁকে হতে হলো কারাবন্দী। সময় কখনো কখনো ফিরে আসে নিষ্ঠুর হয়ে।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment