ফেসবুকে কেন সান্ডা আর ‘কফিলের ছেলে’ বিরাজ করে
গতকাল থেকে ফেসবুক খুললেই মনে হচ্ছে আমরা এক ডিজিটাল চিড়িয়াখানায় ঢুকে পড়েছি। এই চিড়িয়াখানার সেলিব্রেটির নাম ‘সান্ডা’। ভিডিও, রিলস, স্ট্যাটাস – সবখানেই সান্ডা আর সান্ডা! শুধু কি সান্ডা? ওর পেছনে ছুটছে ‘কফিলের ছোট ছেলে’। কেউ আবার রান্না করছে সান্ডার বিরিয়ানি। কিন্তু অনেকেই বুঝতে পারছেন না সান্ডা কী, কফিল কে, আর এত সান্ডা হঠাৎ ফেসবুকে এল কীভাবে? লিখেছেন গৌতম কে শুভ
এখন বাংলাদেশের ফেসবুকে বিরাজ করছে দুই রকম মানুষ। একদল সান্ডা ধরছে, আরেক দল সান্ডা কী, তা বোঝার চেষ্টা করছে। নীল রঙের ফেসবুক খুললেই মনে হচ্ছে, মরুভূমির ঊষর হাওয়ায় আমরা সবাই ভেসে যাচ্ছি। চারদিকে শুধু সান্ডা আর কফিলের ছেলে! এই মরুভূমির প্রাণী সান্ডা হঠাৎ কেন এত আলোচনায়! ব্যাপারটা কি সিরিয়াস, নাকি এটা সিরিয়াসলি ভাইরাল হয়েছে?
সান্ডা কী?
সান্ডা এখন ফেসবুকের ‘সেলিব্রিটি’ হলেও বাস্তবে সে মাটির মানুষ। মানে গর্তের প্রাণী। মরুভূমিতে বাস করা টিকটিকির মতো সরীসৃপ। তবে সাধারণ টিকটিকি বললে ভুল হবে। কারণ এর চামড়া মোটা আর লেজ খসখসে। দেখতে বেশ রুক্ষ।
সৌদি আরবে একে বলা হয় ‘দব’। বৈজ্ঞানিক নাম ‘ইউরোমাস্টিক্স’। ব্রিটানিকা বলছে, এটি আসলে স্পাইনি টেইলড লিজার্ড বা কাঁটাযুক্ত লেজওয়ালা টিকটিকি। অ্যাগামিডি গোত্রের এই লিজার্ডদের আছে এক ডজনের বেশি প্রজাতি। তাই সান্ডা আসলে কোনো একক প্রাণী না, একটা গোত্র। সাধারণত আরব বেদুইন সংস্কৃতি ও মরু অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে এই প্রাণী খাওয়ার প্রচলন আছে।
সাধারণত এরা থাকে মরুর ধারে ধারে। উত্তর আফ্রিকা থেকে শুরু করে ভারতের শুষ্ক এলাকাগুলোতেও দেখা মেলে এদের। আর সৌদি আরব তো এদের নিজের বাড়ি মানে প্রাকৃতিক আবাসস্থল। সান্ডারা দিনে রোদ পোহায় আর রাতে ঢুকে পড়ে গর্তে। বিপদ দেখলেই এরা হুট করে পাথরের ফাঁকে লুকিয়ে যায়। এদের খাদ্যতালিকায় আছে গাছের পাতা আর ফলমূল। তবে মাঝেমধ্যে তারা ছোটখাটো পোকামাকড়ও খায়।
কফিল কে, কে-ই বা কফিলের ছেলে
কফিল আরবি শব্দ। আরব দেশে কফিল বলতে মূলত রক্ষক, নিয়োগকর্তা বা স্পন্সরকে বোঝায়। সৌদি আরব বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশি যেসব শ্রমিক কাজ করেন, তাঁরা মূলত কফিলের অধীনে থাকেন। কফিলই তাদের মালিক। কফিল-ই ঠিক করেন কোন শ্রমিক কোথায় কাজ করবেন, কখন খাবেন, কখন ছুটি পাবেন। এরাই আবার মরুভূমির প্রাণী সান্ডাকে ধরতে পাঠান এই শ্রমিকদের। কখনোবা তাঁদের সঙ্গে থাকেন মালিকের সন্তান, প্রবাসী শ্রমিকেরা যাদের ‘কফিলের ছেলে’ নামে ডেকে থাকেন।
হঠাৎ এত সান্ডা কীভাবে এল
হঠাৎ ভাইরাল হলেও কয়েক বছর আগে থেকেই সৌদিপ্রবাসী শ্রমিকদের ভিডিওতে সান্ডা আর কফিলের ছেলেকে দেখা যেত। মূলত কাজের ফাঁকে ফাঁকে তাঁরা (সৌদিপ্রবাসী শ্রমিক যাঁরা ভ্লগ বানান) নানা ভিডিও বানিয়ে ফেসবুকে আপলোড করতেন।
নানান ধরণের ভিডিওর মধ্যে বাংলাদেশের যেসব প্রবাসী শ্রমিক কফিল আর তাঁর পরিবারের দৈনন্দিন জীবন দেখাতেন, তাদের ভিডিও-ই বেশি জনপ্রিয় হতো। এভাবেই কাঁটা লেজওয়ালা এই সান্ডার নাম ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে আমাদের দেশে, ফেসবুক মহলে।
ভিডিওতে দেখা যায়, কেউ মরুভূমিতে ছুটে গিয়ে সান্ডা ধরছেন, কেউ আবার ধরার আগেই প্রাণীটা গর্তে ঢুকে যাচ্ছে। আর যদি একবার কেউ তাকে ধরে ফেলে, তবে হাহা…হুররে, সেটা দিয়েই রান্না হচ্ছে মজার বিরিয়ানি। আর সেই বিরিয়ানি খাচ্ছেন কফিলের ছেলে, তৃপ্তির হাসি দিয়ে।
এভাবে সান্ডা আর কফিলের ছেলের ভিডিও হঠাৎ-ই কয়েকদিন আগে ফেসবুকের অ্যালগরিদমের জাদুতে অনেক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তারপর ফেসবুকের মিম পেজগুলোতে শুধুই সান্ডা। এভাবে চলতি ট্রেন্ড হিসেবে সংবাদমাধ্যমেও উঠে আসে সান্ডা আর কফিলের ছেলে।
আগেও আমরা ‘সান্ডার তেল’ বা মালিশের নাম শুনেছি
সান্ডা কিন্তু আমাদের দেশে একেবারে নতুন না। আগে রাস্তার মোড়ে, গ্রামের হাটে-বাজারে মজমা দিয়ে ক্যানভাসাররা ‘সান্ডার তেল’ বলে একধরনের তেল বেচতেন। সঙ্গে একটা কাচের বয়ামে তেল রাখতেন। এই তেলে নাকি যৌনশক্তি বাড়ে, এমন প্রচারণা চালাতেন। সেই প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে সহজ-সরল মানুষজন এই তেল কিনতেনও।
এখন অবশ্য মানুষ বেশ সচেতন। কিন্তু গ্রামের হাটবাজারে এখনো দেখা যায় ‘সান্ডার তেল’ বা মালিশ। ধারণা করা হয়, সান্ডার মতো দেখতে গুইসাপ মেরে সেই চর্বি থেকে বানানো হয় এই তেল। কিন্তু বিজ্ঞান বলছে, সান্ডা বা গুইশাপের তেলের কোনো প্রমাণিত ওষুধ গুণ নেই।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment