×

উইচহান্টিং: ডাইনিরা ফিরে আসছে, তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই

শত শত বছর আগে স্কটল্যান্ডে ডাইনি নিধনের নামে যে নারকীয় নির্যাতন চালানো হয়েছিল, আজও তার ইতিহাস আমাদের নাড়া দেয়। রাজনীতি, ধর্মীয় উন্মাদনা ও সামাজিক ভীতির জালে ফেঁসে হাজারো নারী নির্মমতার শিকার হয়েছিলেন। সেই ‘উইচহান্টিং’ আবার ফিরে এসেছে নতুন রূপে, খানিকটা ‘ডার্ক হিউমর’ এর পিঠে ভর করে। বিবিসি অবলম্বনে বিস্তারিত জানাচ্ছেন, শতাব্দীকা ঊর্মি

যখন রাজা জেমস ডেনমার্কের রাজকুমারী অ্যানের সঙ্গে সমুদ্রপথে স্কটল্যান্ডে ফিরছিলেন, তখন তাঁদের পড়তে হয়েছিল সমুদ্রের উত্তাল ঝড়ের মধ্যে। রাজার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, এই ঝড়ের পেছনে হাত ছিল শয়তান ও তার  দলবলের। অর্থাৎ ডাইনিদের ষড়যন্ত্র। এই বিশ্বাস থেকেই ১৫৬৩ সালে পাস হয় স্কটিশ ডাইনি-আইন, যার পরিণতিতে শুরু হয় ভয়াবহ ডাইনি-নিধন।

১৫৬০ থেকে ১৭০০ সাল পর্যন্ত স্কটল্যান্ডে ডাইনি-নিধন ছড়িয়ে পড়ে সব জায়গায়।  অন্তত ৪ হাজার জনকে ডাইনির অভিধা দেওয়া হয়, আর হাজার হাজার মানুষকে ফাঁসি দেওয়া হয়। এই সময়ে ঘটে অমানবিক নির্যাতনের ঘটনা। যার মধ্যে ছিল ‘পিল্লিউইঙ্কস’(আঙুল ভাঙার যন্ত্র), পায়ের হাড় গুড়া করার বুট, আর ‘উইচেজ ব্রাইডেল’  নামে পরিচিত নির্মম শাস্তির উপকরণ। এগুলো ছিল বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার এক একেকটি ভয়ংকর দৃষ্টান্ত।

১৫৭৭ সালে রাজা কিংস জেমস ‘ডেমোনোলজি’ নামে একটি বই লেখেন। যেখানে বলা আছে, কীভাবে ডাইনিদের ও অশুভ আত্মাদের খুঁজে বের করতে হবে ও তাদের মোকাবিলা করতে হবে। বইটিতে বলা হয়েছে, সদ্য প্রোটেস্ট্যান্ট হওয়া স্কটল্যান্ড মূলত তার  ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ডাইনি নিধন আইনটি তৈরি করেছিল। সেখানে  যিনি শয়তানের সঙ্গে ‘ষড়যন্ত্রে’ যুক্ত বলে সন্দেহ করা হতো, তাকে কঠোরভাবে শাস্তি দেওয়া হতো।

নরওয়ে ও যুক্তরাষ্ট্রে স্কটল্যান্ডের মতোই ব্যাপক ডাইনি-নিধন  ও বিচারের ঘটনা ঘটেছিল। পরবর্তীতে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ গড়ে তোলা হয়েছে। তাদের সম্মান জানাতে তৈরি হয়েছে সরকারি পোশাক।

সেই পনের শতকের ‘ডাইনি’ আবার ফিরে এসেছে এই একুশ শতকে। বিশ্বজুড়ে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ডাইনি-বিষয়ক সৌন্দর্য বা নান্দনিকতা গত কয়েক বছর ধরে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। উইচটকের (এমন এক টিকটক যেখানে ডাইনিবিদ্যার কন্টেন্ট দেখানো হয়) অনুসারী ও হ্যাশট্যাগ বাড়ছে ক্রমাগত। ‘উইচকোর’ নামক ফ্যাশন ট্রেন্ড এখনো অনেককে আকর্ষণ করছে। ডাইনি-রোমান্স ফিকশন এখন ‘রোম্যান্ট্যাসি’ ঘরানার একটি সমৃদ্ধ শাখায় পরিণত হয়েছে। সিনেমা ও টেলিভিশনেও বিষয়টি উজ্জ্বল। হলিউডে ‘প্র্যাক্টিক্যাল ম্যাজিক-২’ ছবির কাজ চলছে , যা আগামী বছর মুক্তি পাবে। এরই মধ্যে ‘ডমিনো ডে’ নামের ডাইনি-ভিত্তিক টিভি ড্রামা পেয়েছে এক বিশাল সাফল্য।

এসব ঘটনার ভেতর দিয়ে বোঝা যায়, আজকের দিনে ‘আধুনিক ডাইনিদের’ সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। একজন আধুনিক ডাইনি প্রকৃতিপূজা, তুকতাক, জাদু এবং ভেষজ ও স্ফটিকের ব্যবহারসহ নানা আচারকে তাদের আধ্যাত্মিক চর্চায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। কেউ এটি নিজের আত্মসচেতনতা ও ক্ষমতায়নের পথ হিসেবে নেন, আবার কেউ উইকার (Wicca) মতো ধর্মীয় গোষ্ঠীতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।

গবেষক জো ভেন্ডিতোজ্জি বলেন, ‘সেই সময়ের বিশ্বাস ও সামাজিক ভীতি একসঙ্গে মিলে সৃষ্টি করেছিল এমন এক আতঙ্ক, যার মধ্যে দিয়ে খোঁজ করা হতো বলির পাঠা। এভাবে তাদের নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হতো।’

উইচহান্টিং (ডাইনি শিকার) ধারণাটির পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন করেছিলেন ‘উইচেস অব স্কটল্যান্ড’ পডকাস্টের দুই প্রতিষ্ঠাতা ও আন্দোলনকারী জো ভেন্ডিতোজ্জি এবং ক্লেয়ার মিচেল। তাঁদের লেখা বই ‘হাউ টু কিল আ উইচ: আ গাইড ফর দ্য প্যাট্রিয়ার্কি’; যা মূলত স্কটল্যান্ডের ডাইনি বিচারের ইতিহাস এবং তার পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো বিশ্লেষণ করে লেখা।

২০২২ সালে এই দুই আন্দোলনকর্মীর একটি বড় লক্ষ্য পূরণ হয়। কারণ স্কটল্যান্ডের সে সময়ের ফার্স্ট মিনিস্টার নিকোলা স্টারজেন ইতিহাসের এই ‘বিশাল অবিচারের’ জন্য ডাইনি আইনে নির্যাতিত স্কটিশদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চান। স্কটল্যান্ডের গির্জার কিছু নারী মন্ত্রীও এরপর ক্ষমা প্রার্থনা করেন।

এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সময়ে ডাইনি-বিচার নিয়ে কল্পকাহিনির লেখকরাও নতুন করে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

ইতিহাসবিদ জুডিথ ল্যাংল্যান্ডস-স্কট বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডাইনি বিচারের প্রতি ব্যাপক আগ্রহ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি লক্ষ করা যাচ্ছে। আজও মানুষ সেই ইতিহাসের দ্বারা আতঙ্কিত। রাজা জেমস বাইবেল নিয়ে মোহগ্রস্ত ছিলেন এবং বিশ্বাস করতেন, তিনি ঈশ্বরের প্রতিনিধি এবং ডাইনিরা সংখ্যায় দ্রুত বাড়ছে। অনেক ইতিহাসবিদ একমত যে মায়ের মৃত্যু (স্কটল্যান্ডের রানি মেরির) পর জেমস এমন পরিবেশে বড় হন, যেখানে নারীদের দুর্বল হিসেবে দেখানো হয়। তাঁকে আরও শেখানো হয়, কামনা-বাসনার কারণে নারীদের সহজে প্রভাবিত করা যায়।

ল্যাংল্যান্ডস-স্কট বলেন, তখন ‘উইচ প্রিকার’ বা ‘ব্রডার’ নামে পরিচিত এক ব্যক্তি নিজেকে ডাইনির চিহ্ন শনাক্ত করার বিশেষজ্ঞ বলে দাবি করত। ডাইনি চিহ্নিত করার বিনিময়ে তার আর্থিক লাভের সুযোগ ছিল। সবচেয়ে বিখ্যাত উইচ প্রিকার বা ডাইনি চিহ্নিতকারী ছিলেন জন কিনকেইড । তিনি সতেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে শত শত নারীর নির্যাতন ও মৃত্যুদণ্ডে জড়িত ছিলেন এবং ‘ডাইনির চিহ্ন’ শনাক্ত করার দাবি করতেন।

এই পদ্ধতিতে অভিযুক্তদের সম্পূর্ণ নগ্ন করে পুরুষ-সদস্যদের আয়োজনে ধর্মীয় সভার সামনে পরীক্ষা করা হতো, যাতে শয়তানের দেওয়া চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়। তাদের সারা শরীর কামিয়ে ফেলা হতো।

‘হাউ টু কিল আ উইচ’ বইটিতে ভয়াবহ সব বিবরণের পাশাপাশি রয়েছে ডার্ক হিউমারও। লেখক ভেন্ডিতোজ্জি বলেন, ‘ডাইনি বিচারের ভয়াবহতা ও ঐতিহাসিক সত্য আমরা সব সময় গুরুত্ব সহকারে নিয়েছি। কিন্তু সেই সময়ের কিছু অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক কিংবা হতাশাজনক দিক মোকাবিলায় আমাদের একধরনের ডার্ক হিউমর রাখতে হয়েছিল।’

উইচকোরের জনপ্রিয়তা ও পণ্য হয়ে ওঠা কি নির্যাতনকে ‘রোমান্টিক’ করে তুলছে?

মিচেল বলছেন, ‘না’। আধুনিক যুগের ডাইনিবিদ্যা শত শত বছর আগের উইচক্রাফট নামক অপরাধ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আজ যারা নিজেদের ডাইনি হিসেবে পরিচয় দেয়, তারা সমাজে শয়তানের দূত হিসেবে কাজ করছে- এমন দাবি তারা করে না। আধুনিক ডাইনির ধারণাটি ঐতিহাসিক সংজ্ঞা থেকে অনেক দূরের এক জগৎ।

ইতিহাসবিদ জুডিথ ল্যাংল্যান্ডস-স্কট আশাবাদী কণ্ঠে বলেন, মানুষ সত্য প্রকাশে আগ্রহ দেখাচ্ছে এবং ইতিমধ্যেই ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়েছে—এটা একধরনের আশার ইঙ্গিত।

মানবাধিকারকর্মী ক্ল্যারি মিচেল বলেন, ‘উইচেস অব স্কটল্যান্ড’ তৈরি করা হয়েছে এই ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দিতে এবং এ বিষয়ে সচেতনতা ও বোঝাপড়া বাড়ানোর লক্ষ্যে।

বর্তমানেও দুর্বলদের ওপর এ  ধরণের তকমা লাগানোর প্রচলন আছে।

ভেন্ডিটোজ্জি বলেন, ‘কমিউনিটির দুর্বল সদস্যদের বলির পাঠা বানিয়ে জনমত কিংবা নিরাপত্তা জোরদার করার চেষ্টা যেন না করি। ডাইনিবিচার শত শত বছর আগের ঘটনা হলেও, আমরা এখনো প্রায়ই দেখি- সামাজিক অস্থিরতার সময়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দোষারোপের ঢেউ ওঠে।

ভেন্ডিটোজ্জি ও ক্লেয়ারের মতো ল্যাংল্যান্ডস-স্কট-ও একইভাবে আশাবাদী। তিনি বলেন, ‘যে সত্যটা সামনে আনার জন্য এখন একটি সম্মিলিত আগ্রহ তৈরি হয়েছে এবং যে ক্ষমা চাওয়া হয়েছে- এসবই একরকম আশার আলো।

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment