×

গণিতবিদ ওমর খৈয়াম: সুরার পেয়ালা হাতে অঙ্ক কষতেন যিনি

শতাব্দীকা ঊর্মি 

ওমর খৈয়ামের নাম শুনলেই যেন চোখে ভেসে ওঠে এক ঘোরের ছবি। হাতে সুরার পেয়ালা, চোখে তারার ঝিকিমিকি, আর ঠোঁটে দার্শনিক ছন্দ। ইংরেজ সাহিত্যিক এদওয়ার্ড ফিটজজেরাল্ডের উনিশ শতকের অনুবাদে রোমান্টিক, আনন্দবাদী এক কবির প্রতিমা গেঁথে গেছে পশ্চিমা কল্পনায়। যিনি জীবনের অনিত্যতা, প্রেম ও নিয়তি নিয়ে গান করেন। কিন্তু এই কাব্যিক মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে আছেন আরেক খৈয়াম। একজন গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ, যুক্তিবাদী দার্শনিক।

১০৭৯ সালে, পারস্যের সেলজুক সুলতান মালিক শাহের আহ্বানে খৈয়াম যোগ দেন এক জ্যোতির্বিজ্ঞানী দলে। যাঁর কাজ ছিল পারস্যের ক্যালেন্ডার সংস্কার। ফলাফল ছিল জালালি ক্যালেন্ডার- একটি এমন পঞ্জিকা, যা এতটাই নিখুঁত যে একে বলা হয় ইতিহাসের অন্যতম সেরা সময়-মাপক যন্ত্র।

এই ক্যালেন্ডার বছরের দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করে ৩৬৫.২৪২৪ দিন- জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের চেয়ে বহু উন্নত এবং এমনকি গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডারের চেয়েও অধিক নির্ভুল। ভুল হতো প্রায় পাঁচ হাজার বছরে একদিন! এর পেছনে ছিল সূর্যের গতি, বিষুববিন্দু নিরীক্ষা এবং জটিল লিপইয়ার হিসেবের এক নিপুণ বিজ্ঞান।

খৈয়ামের হাতে কেবল কবিতার কলম ছিল না- ছিল গণিতের কাটাকুটিও।

তবে খৈয়ামের বুদ্ধির প্রকৃত বিস্ফোরণ ঘটে অঙ্কের জগতে। তাঁর লেখা ‘ট্রিটাইজ অন দ্য ডেমোনস্ট্রেশন অব প্রব্লেমস অব অ্যালজেবরা’ ছিল একটি যুগান্তকারী কাজ। সেখানে তিনি ঘনমাত্রার (cubic) সমীকরণসমূহকে প্রথমবারের মতো শ্রেণিবদ্ধ করেন এবং তা সমাধান করতে শুরু করেন জ্যামিতিক পদ্ধতিতে- কণিক ধারা বা  বৃত্ত, পরাবৃত্ত, হাইপারবোলা ব্যবহার করে।

দার্শনিক ও গণিতবিদ দেকার্তের জন্মের কয়েক শতাব্দী আগেই খৈয়াম বুঝতে পেরেছিলেন যে গণিত আর জ্যামিতি একে অন্যের ভাষা হতে পারে। তিনি ছিলেন আধুনিক অ্যালজেব্রার ভিত্তি রচনাকারী, একজন এমন বিজ্ঞানী যিনি সংখ্যা নয়, ভাবনার ক্রমাগত শোধন খুঁজতেন।

কবি খৈয়ামের গবেষণা শুরু হয়েছিল বীজগণিত দিয়ে, আর প্রথমেই তিনি অনুভব করেছিলেন- গ্রিক পদ্ধতিতে ত্রিঘাত সমীকরণের সমাধান অসম্ভব। ১০৭০ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ২২ বছর বয়সে, যখন অনেকেই জীবনের অর্থ খুঁজতে শুরু করে, তখন খৈয়াম সমীকরণের গহিনে প্রবেশ করে লিখে ফেললেন এক যুগান্তকারী গ্রন্থ, ‘ডেমনস্ট্রেশান অব প্রব্লেমস অব অ্যালজেব্রা অ্যান্ড ব্যালান্সিং’।

এই গ্রন্থে তিনি কনিক বিভাগের সাহায্যে ত্রিঘাত সমীকরণের নানা পদ্ধতিতে সমাধান দেখান- বৃত্ত, প্যারাবোলা, হাইপারবোলার জ্যামিতিক পথ ব্যবহার করে।

আশ্চর্যজনকভাবে, তাতে ঋণাত্মক সংখ্যা বা ঋণাত্মক রুট ব্যবহার করেননি। কারণ, তখনো ইসলামিক গণিতবিদদের মধ্যে ঋণাত্মক সংখ্যার ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কিন্তু খৈয়ামের চিত্ত কোথাও অতৃপ্ত ছিল। জ্যামিতিক পদ্ধতি তাঁর মন ভরাতে পারেনি। তিনি চেয়েছিলেন বীজগাণিতিক সমস্যার সমাধান হোক শুধুই বীজগাণিতিক পদ্ধতিতে।

আর সেই চির-অসন্তোষই জন্ম দেয় আরেক কীর্তির- ‘ট্রিটাইজ অন দ্য ডেমনস্ট্রেশান অব প্রব্লেমস অব অ্যালজেব্রা অ্যান্ড ব্যালান্সিং’। যেখানে তিনি ত্রিঘাত সমীকরণের সমাধান করেন নিখাদ বীজগাণিতিক যুক্তিতে। এই কাজ তাঁকে গণিতের মুকুটহীন সম্রাটে পরিণত করে।

মজার বিষয়, তাঁর মৃত্যুর ৫০০ বছর পরেও ত্রিঘাত সমীকরণে তেমন অগ্রগতি হয়নি। কেবল ১৫৩৫ সালে গণিতবিদ নিকোলো টার্টাগ্লিয়া একটি সাধারণ সূত্র বের করেন। অর্থাৎ বীজগণিত তখনো খৈয়ামের ছায়া টপকাতে পারেনি।

খৈয়ামের দর্শনচর্চা ছিল বিজ্ঞানমনস্ক । তিনি ছিলেন ইবন সিনার ভক্ত, কিন্তু একইসঙ্গে তাঁর দর্শনের সমালোচকও। ঈশ্বর, নিয়তি, অস্তিত্ব নিয়ে তাঁর ভাবনা ছিল এমন এক দার্শনিকের, যিনি কুসংস্কারের অন্ধকারে পথ খুঁজে নেন যুক্তির আলোয়।

তাঁর কবিতা তাই আধ্যাত্মিক মায়াজাল নয়, বরং নিঃস্ব সত্যের চিরন্তন আহ্বান।

জনপ্রিয় অনুবাদের ভার

আজ বিশ্বের বহু মানুষ খৈয়ামকে চেনেন কেবল ফিটজজেরাল্ডের রুবাইয়াত অনুবাদের মাধ্যমে। সে এক মায়াবী ও মদ্যপ কবির প্রতিকৃতি, যেখানে বোধ হয় হারিয়ে গেছে গণিতজ্ঞ, জ্যোতির্বিদ, দার্শনিক খৈয়ামের আসল সত্তা।

ফলাফল আমরা কেবল সেই মানুষটিকেই স্মরণ করি, যিনি জীবনকে উপভোগ্য করতে চাইতেন। ভুলে যাই, তিনিই সূক্ষ্মতম গণনার মাধ্যম নির্ধারণ করেছিলেন।

আজকের বিভাজিত, জ্ঞানভিত্তিক দুনিয়ায় ওমর খৈয়ামের সর্বজ্ঞ মনোভাব এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তিনি বিজ্ঞানের যুক্তি, দর্শনের সংশয় এবং কবিতার আবেগ- এই তিনকে এক সূত্রে গাঁথতে পেরেছিলেন।

খৈয়ামের মতো মন আজ দরকার আমাদের—যিনি একাধারে সংখ্যায় মাপেন সৌরজগতের গতি, আবার কবিতায় উচ্চারণ করেন হৃদয়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জমে থাকা প্রশ্ন।

ওমর খৈয়ামের সবচেয়ে বিখ্যাত চতুষ্পদী কবিতাটির দিকে তাকালে, যেন তাঁর বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও কবি সত্তা একসঙ্গে কথা বলে,

‘যেমনি পাবি মন দুই মদ–যেখানে হোক যদিই পাস –
অমনি পানোন্মত্ত ওরে, সে মদ-স্রোতে ডুবে যাস!
যেমনি খাওয়া অমনি হবি আমার মতো মুক্ত-প্রাণ,
ভেসে যাবে রাশভারি তোর ঋষির মতো দাড়ির রাশ।’

লাইনগুলো একজন গণিতবিদের, যিনি জীবনের হিসেব ও দর্শনের কঠোর বাস্তবতা সব একসঙ্গে উচ্চারণ করেন।  একদিকে কবিতা, অন্যদিকে গণিত- দুটি মেরুর মধ্যবর্তী সেতুই যেন ছিলেন ওমর খৈয়াম। রুবাইয়ের মরমি সুরে যিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন, সেই খৈয়ামই আবার বীজগণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে রেখে গেছেন যুগান্তকারী অবদান। তাঁর অন্তর্দৃষ্টি চেয়েছিল বিশুদ্ধ বীজগাণিতিক সমাধান—আর সেখানেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন সময়ের থেকে বহু এগিয়ে থাকা এক স্বপ্নদ্রষ্টা।

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment