চুকনগর গণহত্যা: ৫৪ বছর আগে মানুষের রক্তে যেভাবে লাল হয়েছিল নদীর পানি
আজ চুকনগর গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় খুলনার প্রত্যন্ত অঞ্চল চুকনগরে ভয়ংকর এক গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। কী ঘটেছিল সেদিন? জানাচ্ছেন একরামুল হক শিপলু
‘চুকনগর’ শব্দটি শুনলেই আমার মনে পড়ে এক বীভৎস গণহত্যার কথা। ছোটবেলা থেকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জানার আগ্রহ ছিল আমার। সেই সুবাদে একাত্তরের বিভিন্ন গণহত্যা সম্পর্কে পড়ালেখার শুরু। পরে যখন টেলিভিশনে কাজ করতে শুরু করলাম, তখন সুযোগ ঘটল চুকনগরের গণহত্যা নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করার। এ সময়েই এ এলাকার গণহত্যা নিয়ে আরও বিশদভাবে গবেষণা ও জানাবোঝা তৈরি হলো। সে এক মর্মন্তুদ সত্য কাহিনি বটে।
ভদ্রা নদী পাড়ে অভদ্রদের আক্রমণ
১৯৭১ সালের ২০ মে খুলনার চুকনগরে ভদ্রা নদীর পারে যে গণহত্যা হয়েছিল, বিশ্ব-গণহত্যার ইতিহাসেও তাকে স্থান দেওয়া যাবে। ভদ্রা নদীর পারের নিরপরাধ মানুষের ওপর সেদিন হয়েছিল ইতিহাসের পৈশাচিক, অভদ্র এক আক্রমণ।
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার আটলিয়া ইউনিয়নের চুকনগরের এই অংশ মরা ভদ্রা নামে পরিচিত স্থানীয়দের কাছে। আর এই মরা ভদ্রায় সেদিন মরেছিল কয়েক হাজার মানুষ।
তখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পূর্ববাংলার মানুষের ওপর যে নির্বিচার গণহত্যা শুরু করেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, খুলনার চুকনগরের গণহত্যা তারই ধারাবাহিকতা। তখন এ এলাকায় জড়ো হয়েছিল অসংখ্য মানুষ। শরণখোলা, মংলা, মোড়েলগঞ্জ, কচুয়া, দাকোপসহ আশেপাশের লাখো হিন্দু ধর্মাবলম্বীসহ বিপুলসংখ্যক মানুষের উদ্দেশ্য ছিল ডুমুরিয়া সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারত পৌঁছানো। শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেওয়া। কিন্তু তাঁদের নদী পার হয়ে সীমান্ত দিয়ে ভারতে পৌছানো সম্ভব হয়নি।
শাস্তি বাহিনীর মাধ্যমে খোঁজ পেয়ে সাতক্ষীরা থেকে আসে পাকিস্তানিরা। মুহূর্তেই তাদের ব্রাশফায়ারে তারা পরিণত হয় লাশের স্তুপে। চুকনগর গণহত্যা স্মৃতি পরিষদের একসময়ের সভাপতি অধ্যক্ষ এবিএম শফিকুল ইসলাম দাবি করেন, বর্তমানে যেখানে বদ্ধভূমি রয়েছে, সেখানেই সেদিন দুই থেকে আড়াই হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। এছাড়া চুকনগর বাজার, ভদ্রা নদীর পারে মারা হয়েছিল আরও মানুষকে। ধারনা করা হয়, মাত্র তিন থেকে চার ঘন্টা সময়ের মধ্যে কয়েক হাজার মানুষকে ব্রাশফায়ারকরে মারা হয়েছিল সেদিন।
স্থানীয়দের ভাষায়, সেদিন মানুষের রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল নদীর পানি। শফিকুল ইসলাম আরও দাবি করেন, গণহত্যা স্মৃতি পরিষদ গবেষণা করে দেখেছে, সেদিন প্রায় ১০ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল।
মরা মায়ের বুকের দুধ পান করছিল এক শিশু
২০১১ সালে এই চুকনগর গণহত্যা নিয়ে ‘বদ্ধভূমির সন্ধানে’ নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলাম আমি আর শোভন আরেফ। তখন দেখা ও কথা হয়েছিল এ গণহত্যার শিকার অনেক শহীদ পরিবারের সঙ্গে। তেমনই একজন এরশাদ আলী। তাঁর বাবা চিকন আলী ছিলেন চুকনগরের প্রথম শহীদ। ২০ মে ১৯৭১-এ যখন চিকন আলী শহীদ হন, এরশাদ আলী তখন কিশোর। সেদিনের স্মৃতি তাঁর মনে জ্বলজ্বলে।
এরশাদ আলী বলেন, সেদিন ‘আমি, আব্বা আর আমার ভাই মিলে পাটখেতে কাজ করছিলাম। এসময় হঠাৎই আব্বা বললেন, “ওই দেখো মিলিটারি গাড়ি আসছে। তোমরা তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যাও। আব্বার কথামতো আমরা বাড়ি চলে এলাম।’
এর পরের ঘটনা হলো, হানাদার বাহিনীর নির্বিচার গুলিবর্ষণ। পাকিস্তানি সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর এরশাদ আলী বাড়ি থেকে ফিরে এসে দেখলেন অসংখ্য লাশ, রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারদিক। দেখলেন এই অজস্র লাশের সারিতে তাঁর বাবা চিকন আলীও রয়েছেন।
এরশাদ আলীর ভাষ্য, ‘অনেক লাশের ভীড়ে দেখলাম, ছোট্ট একটা মেয়ে মরা মায়ের দুধ পান করছে। রক্তমাখা সেই মেয়েকে আমি কোলে তুলে নিলাম।’
দীর্ঘ দিন লালন পালন করে সুন্দরী নামের ওই মেয়েকে পরে বিয়েও দিয়েছেন এরশাদ। এই চুকনগর গণহত্যায় শুধু এরশাদ আলী নয়, রয়েছে আরও অনেকেরই এমন গল্প।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment