×

বিবিসির চোখে: ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের ট্রফি কি চীনের ঘরে উঠল

ভারত ও পাকিস্তানের সাম্প্রতিক চার দিনের সীমান্ত সংঘর্ষ যুদ্ধবিরতিতে শেষ হলেও এতে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে চীনের উত্থান চোখে পড়েছে। সশস্ত্র উত্তেজনা, বিমান হামলা ও পাল্টা প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সংঘর্ষে দুই দেশই নিজেদের বিজয়ের দাবি করেছে। তবে তাদের দাবিতে কান না দিয়ে চীনের অস্ত্রশক্তির কার্যকারিতা নিয়েই এখন আলোচনা তুঙ্গে। বিবিসির প্রতিবেদন অবলম্বনে জানাচ্ছেন রাতুল আল আহমেদ

ভারত-পাকিস্তানের ভেতর যে উত্তেজনা চলছিল, তা গিয়ে ঠেকে সংঘর্ষে। চার দিনের সংঘর্ষ মার্কিন মধ্যস্থতায় শেষ হয়েছে যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে। দুই দেশই নিজেদের বিজয়ী দাবি করছে। তবে এখন মনে হচ্ছে জয়ের ট্রফি সম্ভবত চীনের ঘরে উঠেছে। ২২ এপ্রিলে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে সশস্ত্র হামলায় ২৬ পর্যটকের নিহত হওয়ার পর সাম্প্রতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। প্রতিশোধ নিতে ৭ মে ভারত পাকিস্তানের ভেতরে তথাকথিত ‘জঙ্গি স্থাপনায়’ হামলা চালায়।

ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগাম উপত্যকায় পর্যটকদের তাঁদের স্ত্রী পরিবারের সামনেই হত্যা করা হয়। দিল্লি এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করলেও ইসলামাবাদ তা অস্বীকার করে। এই ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে ভারত ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে পাকিস্তানে বিমান হামলা চালায়। এরপর দুই পক্ষই পাল্টাপাল্টি ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র ও যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে।

ভারত ফ্রান্স ও রাশিয়ায় তৈরি যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে হামলা চালায়। অপরদিকে পাকিস্তান চীনের সঙ্গে যৌথভাবে উৎপাদিত জে-১০ ও জেএফ-১৭ যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে এই সংঘাতে। দুই দেশই বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, তাদের বিমান সীমান্ত পাড়ি দেয়নি। নিজ সীমানায় থেকেই দূর থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হয়েছে।

পাকিস্তান দাবি করেছে, তারা অন্তত ছয়টি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করেছে। ফ্রান্স নির্মিত বিখ্যাত `রাফাল‘ বিমানও রয়ছে এর ভেতরে। তবে পাকিস্তানের এই দাবির কোনো উত্তর দেয়নি ভারত।

ভারতীয় বিমান বাহিনীর এয়ার মার্শাল এ কে ভারতী যদিও বলেছেন, ‘যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি হবেই’। তবে তিনি পাকিস্তানের দাবির ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট মন্তব্য করতে রাজি হননি। তাঁর মতে, তাঁরা লক্ষ্যপূরণ করেছেন এবং তাঁদের সব বৈমানিক নিরাপদে ফিরে এসেছে।

এদিকে ভারত দাবি করেছে, তারা পাকিস্তানভিত্তিক নিষিদ্ধ জঙ্গি গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বা ও জয়েশ-ই-মোহাম্মদের সদর দফতরে হামলা চালিয়ে অন্তত ১০০ জন ‘সন্ত্রাসী’কে হত্যা করেছে

বিমানযুদ্ধের স্পষ্ট বিবরণ এখনো প্রকাশিত হয়নি। কিছু সংবাদমাধ্যম পাঞ্জাব ও ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে বিমান ভূপাতিত হওয়ার খবর দিয়েছে। কিন্তু ভারত সরকার এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।

রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে মার্কিন কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, পাকিস্তান চীনের তৈরি জে-১০ যুদ্ধবিমান ব্যবহার করেছে। ওই যুদ্ধবিমান থেকে ভারতীয় বিমান লক্ষ্য করে আকাশ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। পাকিস্তান যে চীনের অস্ত্রে এতটা নির্ভর করে বিজয় দাবি করছে তা চীনা অস্ত্র ব্যবসার জন্য বড় বিজ্ঞাপন হিসেবে দেখা হচ্ছে। যদিও সবাই এতে একমত নয়।

কিছু বিশেষজ্ঞ একে ‘চীনা অস্ত্র শিল্পের ডিপসিক মুহূর্ত’ বলেও অভিহিত করেছেন। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে একটি চীনা এআই স্টার্টআপ যুক্তরাষ্ট্রের টেক জায়ান্টদের কম খরচের প্রযুক্তি এনে চমকে দিয়েছিল।

চীনা পিপলস লিবারেশন আর্মির অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন কর্নেল ঝু বো বিবিসিকে বলেন, ‘এই বিমানযুদ্ধ ছিল চীনা অস্ত্র ব্যবসার জন্য বড় বিজ্ঞাপন। এটাই প্রথম বাস্তব যুদ্ধ পরিস্থিতি যেখানে চীনের যুদ্ধবিমান ব্যবহৃত হয়েছে।’

চীনের চেংদু এয়ারক্রাফট কোম্পানির শেয়ারের দাম ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে যুদ্ধবিমানের সফল ব্যবহারের খবরে। তবে কিংস কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক ওয়াল্টার লাডউইগ বলেন, ‘এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি চীনা বিমানগুলো আসলেই ভারতীয় রাফাল বিমানকে পরাস্ত করতে পেরেছে কি না।’

তিনি আরও বলেন, ‘ভারতীয় বিমান বাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানকে উস্কানি না দিয়ে টার্গেট হিট করা।’ তিনি মনে করেন, ভারতীয় বৈমানিকদের এমন সময় পাঠানো হয় যখন পাকিস্তানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ সক্রিয় ছিল।

বেইজিং যদিও জে-১০ যুদ্ধবিমান দ্বারা ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করার বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেনি, তবুও চীনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে জাতীয়তাবাদী উচ্ছ্বাস দেখা গেছে।

চীন-বিষয়ক গবেষক কার্লোত্তা রিনাউডো বলেন, ‘এই মুহূর্তে বাস্তবতার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘‘ধারণা’’। সেই হিসেবে চীনই মূল বিজয়ী।’
চীনের জন্য পাকিস্তান কৌশলগত ও অর্থনৈতিকভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের অংশ হিসেবে পাকিস্তানে ৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে চীন। তাই দুর্বল পাকিস্তান চীনের চাওয়া নয়।

পাকিস্তানি নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইমতিয়াজ গুল বলেন, ‘চীন এই সংঘর্ষে ভারতীয় পরিকল্পনাবিদদের চমকে দিয়েছে। তাঁরা সম্ভবত পাকিস্তান ও চীনের আধুনিক যুদ্ধ সহযোগিতার গভীরতা কল্পনাও করেনি।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে চীনা যুদ্ধবিমানের কার্যকারিতা পশ্চিমা দেশগুলোতে বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে। বিশ্ব অস্ত্র বাণিজ্যে এর প্রভাব পড়বে।
চীনা অস্ত্রকে আগে তেমন উঁচুমানের মনে করা হতো না। উদাহরণ হিসেবে ২০২২ সালে মিয়ানমার প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে চীনের তৈরি বেশ কয়েকটি জেএফ-১৭ যুদ্ধবিমান ব্যবহার বন্ধ করে দেয় । নাইজেরিয়াও চীনের এফ-৭ বিমানে সমস্যার কথা জানিয়েছিল।

পাকিস্তানের কাছে ভারতের বিমান হারানোর ঘটনা এই প্রথম নয়। ২০১৯ সালের একটি ছোট বিমানযুদ্ধে ভারতের একটি মিগ-২১ ভূপাতিত হয়। আটক হন বৈমানিক। যদিও ভারত দাবি করে, এই বৈমানিক পাকিস্তানের একটি এফ-১৬ গুলি করে ভূপাতিত করেন।

১০ মে সকালে ভারত ১১টি পাকিস্তানি বিমান ঘাঁটিতে একযোগে হামলা চালায়, যার মধ্যে ছিল ইসলামাবাদ লাগোয়া নূর খান বিমান ঘাঁটিও। লাডউইগ বলেন, ‘এইবার ভারত স্ট্যান্ডার্ড সামরিক পদ্ধতি অনুসরণ করেছে। প্রথমে তাঁরা প্রতিপক্ষের বিমান প্রতিরক্ষা ধ্বংস করে তারপর মাটির লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে।’

ভারতীয় হামলা যথেষ্ট নিখুঁত ছিল বলে মনে করা হচ্ছে। বিমান ঘাঁটির রানওয়ের মাঝখানে হামলা করেছিল তারা। তবে ভারতের পক্ষ থেকে মিশনের বিস্তারিত প্রকাশ না করায় ‘ভারত নিজেই প্রচারযুদ্ধের লাগাম হারিয়ে ফেলেছে,’ বলে মন্তব্য করেন লাডউইগ। পাকিস্তানও পাল্টা হামলা চালায়। কিন্তু ভারত বলছে এতে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র দেশগুলোর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের জন্য এই ঘটনা একটি সতর্কবার্তা। চীন প্রকাশ্যে কিছু না বললেও এটা প্রমাণে মরিয়া যে তাদের অস্ত্র পশ্চিমাদের সমতুল্য হয়ে উঠছে। ভারতও জানে পাকিস্তানকে সরবরাহ করা জে-১০ বিমান তুলনামূলক পুরোনো। চীন ইতিমধ্যেই আরও উন্নত জে-২০ যুদ্ধবিমান তাদের বাহিনীতে যুক্ত করেছে। চীন ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে সীমান্ত বিরোধ রয়েছে। ১৯৬২ সালে সীমান্ত যুদ্ধেও ভারত পরাজিত হয়। ২০২০ সালে লাদাখে সীমান্ত সংঘর্ষ হয়েছিল।

এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারতের উচিত নিজস্ব প্রতিরক্ষা শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং আন্তর্জাতিকভাবে অস্ত্র সংগ্রহ ত্বরান্বিত করা। সব মিলিয়ে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে চীনা অস্ত্রের সফল ব্যবহারের দাবির পর চীনের প্রতিরক্ষা বাণিজ্য বিশ্বমঞ্চে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে।

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment