×

যে কণ্ঠস্বর জাগিয়ে তুলেছিল নারীকে

নারীর জাগরণ, প্রগতির দীপ্তি ও সমাজচিন্তার আলোকবর্তিকা হয়ে উঠেছিল ‘সওগাত’ ও এর প্রাণপুরুষ মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। ১৯১৮ সালে শুরু হওয়া এই সাহিত্যপত্র শুধু প্রকাশনা নয়, ছিল এক বিপ্লবী আন্দোলনের নাম—যা নারীর কণ্ঠকে তুলে এনেছিল বাংলার মুসলিম সমাজে প্রথমবারের মতো। ১৮৮৮ সালে জন্ম ২০ নভেম্বর জন্ম নেওয়া নাসিরউদ্দীন মৃত্যুবরণ করেন ১৯৯৪ সালের ২১ মে। আজ মৃত্যুদিন তাঁকে স্মরণ করে লিখছেন শতাব্দীকা ঊর্মি

১৯১৮ সালের ২ ডিসেম্বর, কলকাতার বুকে জন্ম নেয় এক বিপ্লবী প্রকাশনা—সওগাত। এটি ছিল শুধু একটি সাহিত্যপত্র নয়; বরং তা হয়ে উঠেছিল একটি চিন্তাচেতনার আন্দোলন, একটি সমাজসংশোধনের ঘোষণা। আর এর প্রাণপুরুষ ছিলেন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন—একজন সম্পাদক, সমাজসংস্কারক এবং ইতিহাসের দুর্লভ নির্মাতা। বাংলা ভাষার মুসলিম সমাজে আধুনিকতা, নারীর মুক্ত চিন্তা ও সাহিত্যের প্রগতিশীল ধারার সূচনা ঘটেছিল যার হাত ধরে, তিনি ছিলেন একা কিন্তু অদম্য।

শিকড় ও সংগ্রামের শুরুর গল্প

১৮৮৮ সালের ২০ নভেম্বর, চাঁদপুর জেলার পাইকারদি গ্রামে জন্ম নেন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় তাঁর চলার পথ দীর্ঘ হয়নি, কিন্তু আত্মশিক্ষায়, অভিজ্ঞতায়, পাঠাভ্যাসে এবং তৎকালীন সমাজ ও রাজনীতির তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণে তিনি গড়ে তোলেন এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি স্টিমার কোম্পানিতে সহকারী স্টেশনমাস্টার হিসেবে কাজ করেন, পরে বিমা কোম্পানিতে কাজ করলেও তাঁর প্রকৃত পরিচয় তৈরি হয় সংবাদপত্র ও সাহিত্যভুবনের মাটি ছুঁয়ে।

সওগাত’ এক বিস্ময়কর রেনেসাঁর নাম

মাসিক ‘সওগাত’ যখন প্রথম কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়, তখন সমাজে মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে প্রবল রক্ষণশীলতা, নারীবিদ্বেষ ও ধর্মীয় গোঁড়ামি বিরাজমান। এমন এক সময়ে ‘সওগাত’ হয়ে উঠল যুক্তিবাদ, মানবিকতা এবং শিল্প-সাহিত্যের আধুনিক বোধের আশ্রয়স্থল। কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প, অনুবাদ—সবকিছুতেই ছিল সমাজ সচেতনতার ছোঁয়া। নাসিরউদ্দীনের সম্পাদনায় এই পত্রিকাটি একটি প্ল্যাটফর্মে রূপান্তরিত হয়, যেখানে একদিকে সাহিত্যচর্চা, অন্যদিকে রাজনৈতিক-সামাজিক চিন্তার বিকাশ সমানতালে চলতে থাকে।

১৯২২ সালে আর্থিক সংকটে পড়ে ‘সওগাত’-এর প্রকাশনা কিছুদিন বন্ধ থাকে। তবে ১৯২৬ সালে নাসিরউদ্দীন তা পুনরায় চালু করেন এবং গড়ে তোলেন ‘সওগাত সাহিত্য মজলিস’—যা তরুণ লেখকদের সাহিত্যে প্রবেশাধিকার তৈরি করে দেয়। এখান থেকেই উঠে আসেন কাজী নজরুল ইসলাম, শামসুন্নাহার মাহমুদ, সুফিয়া কামাল, বেগম রোকেয়ার মতো প্রগতিশীল চিন্তাবিদ ও সাহিত্যিক।

নারীর স্বর: ‘জানানা মহল 

সময়ের নিরিখে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের সবচেয়ে বিপ্লবী পদক্ষেপ ছিল নারীর লেখালেখিতে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা। ১৯২৭ সালে ‘সওগাত’-এ ‘জানানা মহল’ নামে নারীদের জন্য একটি স্বতন্ত্র বিভাগ চালু করেন তিনি। এখানে প্রকাশ পেতে থাকে নারীদের লেখা, এমনকি নারীর ছবি—যা তৎকালীন মুসলিম সমাজে ছিল অকল্পনীয়।

এই আয়োজন থেকেই বেগম রোকেয়া, শামসুন্নাহার মাহমুদ, সুফিয়া কামালের মতো নারীরা পত্রিকাজগতে পদার্পণ করেন। এর ফলে মুসলিম সমাজে নারীর পরিচয় ও কণ্ঠস্বর স্পষ্ট হতে থাকে। সওগাত যেন হয়ে ওঠে নারী মুক্তির এক প্রাগ্রসর মঞ্চ।

বিবিধ রূপে সওগাতের বিস্তার

নাসিরউদ্দীন কখনো থেমে থাকেননি। সময় ও সমাজের প্রেক্ষাপটে তিনি সওগাত-এর বিবিধ রূপ উপস্থাপন করেন। ১৯৩৩ সালে বার্ষিক সওগাত, ১৯৩৪ সালে সাপ্তাহিক ‘সওগাত’, ১৯৩৭ সালে ‘সচিত্র মহিলা সওগাত’-এবং শিশুদের জন্য ‘শিশু সওগাত’—এই সকল প্রকাশনার মাধ্যমে তিনি একটি পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ভিত্তি রচনা করেন।

এমনকি, ১৯৪৬ সালে নাসিরুদ্দীন প্রকাশ করেন ‘বেগম’ পত্রিকা—বাংলা ভাষার প্রথম সচিত্র নারীবিষয়ক সাপ্তাহিক, যার সম্পাদনায় পরে যুক্ত হন তাঁর কন্যা নূরজাহান বেগম। এই উত্তরাধিকার নারীবিষয়ক সাংবাদিকতাকে নিয়ে যায় এক নতুন উচ্চতায়।

দেশভাগ ও নতুন ঠিকানা: ঢাকায় সওগাত

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন। কিছুদিন সওগাত বন্ধ থাকলেও ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বর মাসে আবার তার পুনর্জন্ম ঘটে ঢাকায়। ‘সওগাত’ অফিসকে ঘিরে গড়ে ওঠে এক প্রাণবন্ত সাহিত্যিক আড্ডা। প্রবীণদের সঙ্গে সেখানে উঠতি প্রতিভারাও যুক্ত হন। কাজী মোতাহার হোসেন, সুফিয়া কামাল, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা ছিলেন প্রবীণ চিন্তাবিদদের প্রতিনিধি। আর নবীনদের মধ্যে ছিলেন আবদুল গনি হাজারী, সরদার জয়েনউদ্দীন, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদুল্লাহ কায়সার প্রমুখ।

এই পর্বে ‘সওগাত’ হয়ে ওঠে পূর্ববাংলার নবজাগরণের সঞ্চারক শক্তি—যেখানে একইসঙ্গে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটে।

‘সওগাত’-এর আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল তার ব্যঙ্গচিত্র বা কার্টুন। সমাজের ভণ্ডামি, কুসংস্কার ও বৈষম্যকে লক্ষ্য করে ধারালো ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করা হতো। এর পরিকল্পনায় নিজেই থাকতেন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। এটি ছিল এক ধরনের নীরব অথচ অপ্রতিরোধ্য প্রতিবাদ, যা পাঠকের বিবেককে নাড়া দিত।

স্বীকৃতি ও উত্তরাধিকার

নাসিরউদ্দীনের জীবনের কর্মযজ্ঞ শুধু একটি পত্রিকা প্রকাশেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ১৯৩৩ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন সওগাত কালার প্রিন্টিং প্রেস। এর মাধ্যমে মুসলিম বাংলার মুদ্রণ ইতিহাসে শুরু হয় নতুন অধ্যায়। তিনি বাংলা একাডেমির ফেলো ছিলেন, ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর এবং নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য।

নাসিরউদ্দীন কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৭৫ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৭৭ সালে একুশে পদক এবং স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারে ভূষিত হন।

১৯৯৪ সালের ২১ মে, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। রেখে যান এক গভীর আদর্শ, এক অন্তর্দৃষ্টি যা যুগ যুগ ধরে পথ দেখাবে চিন্তাশীল মানুষকে।

নাসিরউদ্দীন ছিলেন এমন এক আলোকবর্তিকা, যিনি অন্ধকার সমাজে আলো জ্বালিয়েছিলেন যুক্তির, সাহসের, সহমর্মিতার দীপ্তিতে। সওগাত ছিল তাঁর দৃষ্টি ও বিশ্বাসের মূর্ত প্রতীক, একটি কাগজে ছাপা বিপ্লব, যা এখনও বাংলা সাংবাদিকতা ও সাহিত্য ইতিহাসে গর্বের অধ্যায় হিসেবে উজ্জ্বল হয়ে আছে।

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment