×

‘হোয়াইট জেনোসাইড’-এর প্রমাণ দিতে ভুয়া ছবি দেখালেন ট্রাম্প

ভুয়া ছবি দেখিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘শ্বেতাঙ্গ হত্যাযজ্ঞের’ অভিযোগ তুলেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। কঙ্গোর একটি সংঘর্ষের ভিডিওর স্ক্রিনশট দেখিয়ে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন। এ নিয়ে রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুসারে লিখেছেন সৈকত আমীন

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকে ‘ভুয়া প্রমাণ’ দেখিয়ে দেশটিতে গণহারে শ্বেতাঙ্গদের হত্যা বা হোয়াইট জেনসাইডের অভিযোগ তুলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ হত্যার প্রমাণ হিসেবে বৈঠকে তিনি যে ছবি ব্যবহার করেছেন, তা আসলে আফ্রিকার আরেকটি দেশ কঙ্গোর বিদ্রোহী গোষ্ঠীর আক্রমণে নিহত ব্যাক্তিদের ছবি। 

গত বুধবার (২১ মে) হোয়াইট হাউজে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার সঙ্গে ওভাল অফিসে একটি বৈঠক হয় ট্রাম্প প্রশাসনের। বৈঠকটির একপর্যায়ে ট্রাম্প আফ্রিকার প্রেসিডেন্টের প্রতি আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন। এ সময় তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘হোয়াইট জেনোসাইড’-এর প্রমাণ হিসেবে একটি প্রিন্ট করা আর্টিকেল ও ছবি তুলে ধরেন। ছবিটি ছিল একটি ব্লগ পোস্ট থেকে নেওয়া। যেখানে রয়টার্সের ভিডিও থেকে নেওয়া একটি স্ক্রিনশট ছিল। ছবিটি দেখিয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘এরা সবাই শ্বেতাঙ্গ কৃষক (লাশগুলো), যারা সমাহিত হচ্ছেন।’

মূলত ছবিটি ছিল কঙ্গোর গোমা শহরে ‘এম২৩’ বিদ্রোহীদের আক্রমণের পর ধারণ করা একটি ভিডিওর অংশ। চলতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি বার্তা সংস্থা রয়টার্স ওই ভিডিওটি প্রকাশ করে। 

ভিডিওতে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও স্থানীয় সাহায্যকর্মীরা গণকবর থেকে কিছু মৃতদেহ বহন করছে। ঘটনাটি ছিল কঙ্গোর ‘এম২৩’ বিদ্রোহীদের এক আক্রমণের পরের পরিস্থিতির। এম২৩ গোষ্ঠীর আক্রমণে তখন বেশ কিছু মানুষ নিহত হয়। ভিডিওটি ধারন করেছিলেন রয়টার্সের ভিডিও সাংবাদিক জাফার আল কাতান্তি।

রয়টার্সের সাংবাদিকের প্রতিক্রিয়া

ভিডিওটির বিষয়ে জাফার আল কাতান্তি রয়টার্সকে বলেন, সেদিন সাংবাদিকদের পক্ষে সেখানে ঢোকা খুব কঠিন ছিল। আমাকে এম২৩ বিদ্রোহীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে হয়েছিল। আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের সঙ্গে সমন্বয় করে অনুমতি নিতে হয়েছিল ভিডিও করার জন্য। শুধু রয়টার্সই সেখানে ভিডিও করতে পেরেছিল।

জাফার আল কাতান্তি আরও বলেন, বিশ্বের সামনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আমার ভিডিও ব্যবহার করেছেন। আমি যেটি কঙ্গোতে তুলেছিলাম, সেটি ব্যবহার করে তিনি দাবি করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গদের হত্যা করা হচ্ছে। আমি অবাক হয়েছি।

ট্রাম্প যেভাবে ভিডিওটি ব্যবহার করলেন

হোয়াইট হাউজে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকের সময়  ট্রাম্প একটি ভিডিও চালান। ভিডিওটি দেখিয়ে তিনি বলেন, এটি প্রমাণ করে দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের গণহত্যা চলছে। এরপর তিনি একের পর এক প্রিন্ট করা আর্টিকেল দেখিয়ে বলতে থাকেন ‘মৃত্যু, মৃত্যু, মৃত্যু, ভয়ংকর মৃত্যু।’

ট্রাম্পের এই আচরণের সঙ্গে মিল পাওয়া যায় ‘হোয়াইট জেনোসাইড’ নামে ষড়যন্ত্রতত্ত্বে বিশ্বাসীদের। এই তত্ত্ব বহু বছর ধরে চরম দক্ষিণপন্থী গ্রুপগুলোর মধ্যে চর্চিত হচ্ছে। যেখানে দাবি করা হয়, দক্ষিণ আফ্রিকায় কৃষ্ণাঙ্গরা ইচ্ছাকৃতভাবে শ্বেতাঙ্গদের হত্যা করছে। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার এমন অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে।

‘আমেরিকান থিংকার’ ব্লগ পোস্ট

ট্রাম্প যে ব্লগ পোস্ট থেকে ছবি দেখিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে শ্বেতাঙ্গ নির্যাতনের জন্য অভিযুক্ত করেছেন, সেটি ছিল ‘আমেরিকাণ থিংকার’ নামে একটি রক্ষণশীল ওয়েবসাইটে প্রকাশিত। পোস্টটিতে কঙ্গো ও দক্ষিণ আফ্রিকার সংঘাত নিয়ে লেখা হয়েছিল। পোস্টে ছবিটির নিচে কোনো ক্যাপশন ছিল না। শুধু লেখা ছিল, এটি ‘ইউটিউব স্ক্রিন গ্র্যাব’ (ইউটিউব ভিডিও থেকে নেয়া স্ক্রিনশট)। 

পোস্টটির লেখক ও ওয়েবসাইটটির ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আন্দ্রেয়া উইডবার্গ রয়টার্সকে বলেন, ট্রাম্প ছবিটি ভুলভাবে চিহ্নিত করেছেন।
আন্দ্রেয়া উইডবার্গ আরও বলেন, ব্লগে পোস্টটি মূলত দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট রামাফোসার ‘দুর্বল, জাতিবাদী, মার্কসবাদী সরকারের’ সমালোচনা করে লেখা হয়েছিল। তিনি দাবি করেন, তাদের পোস্টে দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গদের ওপর ‘বর্ধিত চাপ’ থাকার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছিল। তবে কোনো হত্যার প্রমাণ হিসেবে ছিল না। 

রামাফোসার যুক্তরাষ্ট্র সফর ও প্রেক্ষাপট

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা যুক্তরাষ্ট্র সফরে এসেছেন সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে। কারণ, ট্রাম্প কয়েক মাস ধরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে অভিযোগ করে আসছেন। তাঁর অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, ভূমি আইন নিয়ে সমস্যা, দক্ষিণ আফ্রিকার বৈদেশিক নীতি এবং শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘুদের সঙ্গে সরকারের খারাপ আচরণ। দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার এসব অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে প্রতিনিয়ত অস্বীকার করে আসছে।

হোয়াইট হাউসের নীরবতা

রয়টার্স যখন হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের ‘ভুয়া প্রমাণের’ বিষয়ে মন্তব্য চায়, তখন তারা কোনো উত্তর দেয়নি। তবে বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে।

রয়টার্সের ফ্যাক্টচেক বিভাগ মূল ঘটনার সত্যতা প্রকাশ করে দেখিয়েছে কীভাবে একজন রাষ্ট্রপতিও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তথ্য বিকৃত করতে পারে। 

সংস্থাটি বলছে, ট্রাম্পের এই কাজ ভুল তথ্য ছড়ানোর একটি বিপজ্জনক উদাহরণ। একজন রাষ্ট্রপ্রধানের এভাবে ভুল ছবি তুলে মিথ্যা দাবি করা শুধু ভ্রান্ত নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও সাংবাদিকতার নৈতিকতার জন্য হুমকিস্বরূপ।

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment