×

আমরা কি ‘সরি’ বলতে অভ্যস্ত

অস্ট্রেলিয়ায় প্রতি বছর ২৬ মে ‘সরি দিবস’ পালনের শুরু হলেও ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। ইন্টারনেট ঘেঁটে বিস্তারিত জানাচ্ছেন মারুফ ইসলাম

পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ সম্ভবত ‘সরি’ বলা। আন্তরিকভাবে দুঃখপ্রকাশ করার চেয়ে কঠিন কিছু নেই। কারণ, দুঃখপ্রকাশ করার অর্থ হচ্ছে পরোক্ষাভাবে ভুল স্বীকার করে নেওয়া। আর মানুষ স্বভাবতই ভুল স্বীকার করতে চায় না। ভুল স্বীকার করলেই যেন একটু ‘ছোট হয়ে গেলাম’ অনুভূতি হানা দেয়।

তারপরও কেউ কেউ সরি বলেন। অবলীলায় দুঃখপ্রকাশ করেন। তাঁরা নিঃসন্দেহে সবার কাছে প্রিয়ভাজন হয়ে থাকেন।

কিন্তু বাঙালি জাতিগতভাবেই সরি বলায় অভ্যস্ত নয়। কী এক অব্যাখ্যাত সংকোচবোধ তাঁকে সরি বলা থেকে দূরে রাখে। বাবা কোনো দিন ছেলেকে সরি বলে না, ছেলে কোনো দিন বাবার কাছে দুঃখপ্রকাশ করে না। মায়ের কাছে ছেলের দুঃখপ্রকাশ, সে এক বিরল ঘটনা।

ঝোঁকের মাথায়, উত্তেজনার বশে কত কিছুই বলে ফেলি আমরা। পরে হয়তো অনুশোচনাও হয়। কিন্তু সরি আর বলা হয় না।

কেন সরি বলতে পারি না
মার্কিন মনোবজ্ঞিানী ও লেখক গাই উইনচ মানুষের অনুশোচনা ও দুঃখবোধ নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন। এই মনোবিজ্ঞানী মানুষের সরিন বলতে না পারা স্বভাবের পেছনে অন্তত পাঁচটি কারণ খুঁজে পেয়েছেন। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সাইকোলজি টুডেতে এ নিয়ে তিনি একটি নিবন্ধও লিখেছেন। গাই উইনচের মতে–

১. নিজের ভুল স্বীকার করা একটি বড় সমস্যা। কারণ, মানুষ আসলে নিজেদের আচরণকে নিজেদের চরিত্র থেকে আলাদা করতে পারেন না। তাঁরা ভাবেন, এগুলো তাঁর স্বভাবের অংশ। তাঁরা বুঝতে পারেন না যে ছোটখাট ভুল সবাই করে। এটা দিয়েই সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্ব বিচার করা যায় না। ক্ষমা চাওয়া তাঁদের কাছে নিজের ব্যক্তিত্বের ওপর আঘাত বলে বোধ হয়।

২. বেশির ভাগ মানুষের ক্ষেত্রে ক্ষমা চাওয়ার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অপরাধবোধ। যেমন ভুল অপরাধবোধের মাত্রাও তেমন কম-বেশী। কিন্তু কখনোই ক্ষমা না চাওয়া এই মানুষেরা বোধ করে লজ্জা। নিজেকে দোষী ভাবার চেয়ে নিজেকে নিয়ে লজ্জিত হওয়া বেশি কষ্টদায়ক।

৩. যেখানে আমরা চিন্তা করি, সরি বললে আমাদের সম্পর্কের টানাপোড়েন কমবে, সেখানে ক্ষমা চাইতে ভীত মানুষেরা মনে করেন, ক্ষমা চাওয়া আরও অভিযোগের দ্বার খুলে দেবে। তারা মনে করেন, এতে সম্পর্কের তিক্ততা আরও বাড়বে। কারণ, অভিযোগকারী তখন পুরোনো আরও বিষয়কে টেনে আনবেন যেগুলো জন্য তিনি সরি বলেননি।

৪. এ ধরনের মানুষেরা মনে করেন ক্ষমা চাইলে তাঁদের পুরো ঘটনার সম্পূর্ণ দায় নিয়ে নিতে হবে। এতে তাঁরা তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। বাস্তবে যেকোনো সম্পর্কে দায় থাকে দুই পক্ষেরই। কোনো ভুলত্রুটি হলে বা রেগে গেলে তাঁর সবকিছুরই কোনো না কোনো কারণ থাকে। যে কারণের দায় অভিযোগকারীর। সুতরাং একজনকেই দোষী হয়ে অবনত হয়ে থাকতে হবে এমন আসলে কিছু নেই।

৫. ক্ষমা চাইতে না চাওয়া মানুষেরা আসলে নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। রেগে যাওয়া, বিরক্তি প্রকাশ, আবেগের দূরত্ব এসবকিছুই মেনে নেওয়া তাদের জন্য সহজ। কিন্তু ক্ষমা চাওয়া নয়। ক্ষমা চাওয়ার প্রসঙ্গটি তাঁদের হতাশ করে। নিজের ব্যক্তিত্ব নিয়ে যে সংকট তাঁদের মধ্যে তৈরি হয়, সেটি তাঁরা কাটিয়ে উঠতে পারেন না।

তারপরও মানুষ ক্ষমা চাওয়ার চর্চা করে। দুঃখপ্রকাশের চর্চা করে। এ নিয়ে পৃথিবীতে আছে দুঃখপ্রকাশ দিবসও।

আজ ‘সরি’ বলার দিন
অস্ট্রেলিয়া প্রতি বছর ২৬ মে দুঃখপ্রকাশ দিবস বা ‘সরি ডে’ হিসেবে পালন করে থাকে। এর পেছেনে ছোট্ট কিন্তু করুণ এক ইতিহাস।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস বলছে, বিংশ শতাব্দীর দিকে অস্ট্রেলিয়া সরকার হাজার হাজার আদিবাসী এবং টরেস স্ট্রেইট দ্বীপপুঞ্জের শিশুকে তাদের পরিবার থেকে জোরপূর্বক আলাদা করে ফেলেছিল। এই শিশুদের সরকারি প্রতিষ্ঠান, মিশনারি হোম অথবা শ্বেতাঙ্গ পরিবারগুলোর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। লক্ষ্য ছিল ‘সভ্য সমাজে’ তাদের নিয়ে আসা, কিন্তু এটি তাদের সংস্কৃতি এবং পরিচয় কেড়ে নয়।

এই ঘটনার অনেক পরে ২৬ মে সেইসব শিশুদের জন্য উৎসর্গ করা হয়, যারা নিজ নিজ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। এটি এমন একটি দিন যখন সমগ্র অস্ট্রেলীয় জাতি সেই ভয়াবহ ভুলের জন্য ক্ষমা চায় এবং ভবিষ্যতে উন্নতির প্রতিশ্রুতি দেয়।

কবে প্রথম সরি দিবস শুরু হয়েছিল
১৯৯৭ সালে ‘ব্রিংগিং দেম হোম’ নামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যেখানে সেই শিশুদের বেদনা তুলে ধরা হয়। এর পরের বছর ১৯৯৮ সালের ২৬ মে প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়ায় ‘জাতীয় দুঃখ দিবস’ পালিত হয়, যার মাধ্যমে সমগ্র দেশ প্রকাশ্যে এই অন্যায়কে মেনে নেয় এবং ক্ষমা চায়।

এরপর ধীরে ধীরে সরি দিবস সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এখন অস্ট্রেলিয়ার বাইরেও বহু দেশে সরি দিবস পালিত হয়। জীবনের কোথাও কোনো অসতর্ক মুহূর্তে হয়তো কারো সঙ্গে কটু কথা বলেছিলেন, সেই দুঃখবোধ থেকে সেই মানুষটির কাছে সরি বলার জন্য ২৬ মে দিনটিকে বেছে নেন অনেকেই।

আপনার জীবনে আছে কোনো অনুশোচনার ঘটনা? তাহলে আজই বলে ফেলুন, ‘সরি’। সংকোচ ঝেড়ে ফেলার হয়তো আজই একটি সুযোগ।

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment