×

জিয়াউর রহমানের জীবনের শেষ ২৪ ঘণ্টা

বাংলাদেশের এক ক্রান্তিময় সময়ে জিয়াউর রহমানের উত্থান। তিনি যখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, সে সময় ১৯৭৮ সালের ৩০ মে সেনাবাহিনীর কতিপয় ষড়যন্ত্রীর হাতে তিনি প্রাণ হারান। কেমন ছিল তাঁর জীবনের শেষ ঘণ্টাগুলো? আজ তাঁর শাহাদাত বার্ষিকীতে সেই ঘটনা জানাচ্ছেন সৈকত আমীন

১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণ করার পর ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এসেছিল দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক অস্থিরতা। তবে এর সবকিছুই পরিবর্তন হয়ে যায় ১৯৮১ সালের ২৯ মে-এর পরের ২৪ ঘণ্টায়।

১৯৮১ সালের ২৯ মে। দিনটা ছিল শুক্রবার। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান পা রাখেন চট্টগ্রামে। উদ্দেশ্য ছিল তাঁর দল বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন করা। বিশেষ করে চট্টগ্রামে দলের বিভক্তি মেটানো। কিন্তু ভাগ্যবিধাতা ছাড়া সম্ভবত কেউই তখন জানতেন না, এ সফরই হবে তাঁর জীবনের শেষ সফর। এটি সেই চট্টগ্রাম, যেখানে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতির ক্রান্তিলগ্নে তিনি করেছিলেন স্বাধীনতার ঘোষণা। 

উপেক্ষিত সতর্কবার্তা 

সকালবেলা জিয়া বাংলাদেশ বিমানের নিয়মিত ফ্লাইটে চট্টগ্রাম পৌঁছান। সঙ্গে ছিলেন দলের মহাসচিব অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য আমেনা রহমান। সফরের উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক। চট্টগ্রামে দলের ঐক্য ফিরিয়ে আনা। তিনি ইরান-ইরাক যুদ্ধ নিয়ে আল-কুদস কমিটির বৈঠক পিছিয়ে দিয়ে এই সফরে যান। যা থেকে বোঝা যায়, এটি ছিল তাঁর জন্য অগ্রাধিকারমূলক এক পদক্ষেপ। 

তবে এর বিপরীতে সামরিক গোয়েন্দা প্রধান মেজর জেনারেল মোহাব্বত জান চৌধুরী তাঁকে এই সফর থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করেছিলেন। সতর্ক করেছিলেন চট্টগ্রামে সেনানিবাসের অস্থিরতা এবং জিওসি জেনারেল আবুল মঞ্জুরের সন্দেহজনক গতিবিধি সম্পর্কে। মঞ্জুরকে গ্রেপ্তার করার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু জিয়া তা প্রত্যাখ্যান করেন। আত্মবিশ্বাস, নিয়তির প্রতি বিশ্বাস এবং একজন সাবেক সেনানায়কের সাহসই হয়তো তাঁকে এমন ঝুঁকি নিতে উদ্বুদ্ধ করে।

চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে জিয়াকে স্বাগত জানাতে মঞ্জুর অনুপস্থিত ছিলেন, যা ছিল অস্বাভাবিক ও তাৎপর্যপূর্ণ। অন্যদিকে মঞ্জুর তখন সেনাপ্রধান হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের আদেশে স্টাফ কলেজে বদলির আদেশপ্রাপ্ত ছিলেন। প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন পরিবারসহ সেখানে যাওয়ার। এশরাদের এই সিদ্ধান্তে বিব্রত ছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়া, অসন্তুষ্ট ছিলেন মঞ্জুর নিজেও। চট্টগ্রামে সেনা অস্থিরতার আগুনে বাতাস দিয়েছিল এই ঘটনা। যা পরে ষড়যন্ত্রের সূত্রে পরিণত হয়।

দুপুর থেকে সন্ধ্যা: দলীয় ঐক্যে নিমগ্ন

সার্কিট হাউসে পৌঁছে জিয়া বিএনপির সাংগঠনিক সভায় অংশ নেন। দুপুরে তিনি জুমার নামাজ আদায় করেন চকবাজারের চন্দনপুরা মসজিদে। মুসল্লিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় শেষে ডাল-ভাতের সাদামাটা মধ্যাহ্নভোজ সারেন। এটি ছিল সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর একাত্মতার প্রকাশ।

এরপর রাত ১১টা পর্যন্ত টানা দলীয় সভায় অংশ নেন জিয়া। এ সময়ের মধ্যে চট্টগ্রামের বেসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করেন তিনি। 

এই সময়েই নিরাপত্তায় বড় এক ফাঁক সৃষ্টি হয়। জিয়া নিজেই ডিজিএফআই প্রধান মেজর জেনারেল মোহাব্বত জান চৌধুরীকে ঢাকায় ফিরে যেতে বলেন। ফলে সার্কিট হাউসের নিরাপত্তা দায়িত্ব পড়ে মাত্র কয়েকজন গার্ড ও দুই দেহরক্ষীর ওপর। যা একজন রাষ্ট্রপতির জন্য ছিল চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা।

রাত ১১.৩০: চূড়ান্ত ষড়যন্ত্র

ঠিক রাত সাড়ে এগারোটায় চট্টগ্রামের কালুরঘাট এলাকায় এক গোপন বৈঠকে মিলিত হন লেফটেন্যান্ট কর্নেল মতিউর রহমান ও অন্য ষড়যন্ত্রকারীরা। বৈঠকের স্থান ছিল লেফটেন্যান্ট কর্নেল দেলোয়ারের বাসা। সেখানে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে হত্যা করার চূড়ান্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।

মতিউর ছিলেন ক্ষুব্ধ। সেনাপ্রধান এরশাদের পক্ষপাতমূলক আচরণ এবং বিদেশে প্রশিক্ষণের সুযোগ থেকে বাদ পড়ার জন্যই ছিল তাঁর এই ক্ষোভ। এই ব্যক্তিগত ক্ষোভ তাঁকে নৃশংস সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত করে। যদিও অন্যান্য কর্মকর্তারা ভেবেছিলেন, এটি হবে একটি ‘রক্তপাতহীন অভ্যুত্থান’, মতিউর সেই সীমা অতিক্রম করেন।

ষড়যন্ত্রকারীরা তিনটি দলে বিভক্ত হয়—গেট দখল, আক্রমণ এবং পালানোর পথ রুদ্ধ করার জন্য বাইরে মোতায়েন।

৩০ মে ভোর ২.৩০–৩.৪০: ট্র্যাজেডির উপসংহার

চট্টগ্রামে তখন ভ্যাপসা গরম, রাতভর বৃষ্টি আর বজ্রপাত শেষে এক থমথমে নীরবতা নেমে এসেছে। সার্কিট হাউসে জিয়া তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে ফজরের অপেক্ষায় ছিলেন। ছিলেন সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরিহিত অবস্থায়।

ভোররাত সাড়ে তিনটা নাগাদ ষড়যন্ত্রকারীরা সার্কিট হাউস ঘিরে ফেলে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফজলে হাসান দুটি রকেট লঞ্চ করেন। যেগুলো ভবনটির কার্নিশে আঘাত করে বিস্ফোরিত হয়। জিয়া ঘর থেকে বের হয়ে সিঁড়ির দিকে এগোন। প্রথম দলের ক্যাপ্টেন মোসলেহউদ্দিন তাঁকে বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে যেতে হবে, স্যার।’

কিন্তু কোনো কথার সুযোগ না দিয়েই দ্বিতীয় দলের নেতৃত্বে থাকা মতিউর রহমান সাবমেশিনগান দিয়ে গুলি চালান । মাথা ও বুকে ২৭টি বুলেটে বিদ্ধ হয়ে মুহূর্তেই নিহত হন বাংলাদেশের সেই সময়ের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। বিভিন্ন বইয়ে উল্লেখ আছে, মতিউর তখন ছিলেন মদের নেশায় মত্ত।  হয়তো সিদ্ধান্তের ভার তিনি নিজেও বহন করতে পারছিলেন না।

এই আচমকা হত্যাকাণ্ড ষড়যন্ত্রকারীদের অনেককেই হতবাক করে।  কারণ, তাঁদের অনেকে এমন নিষ্ঠুর সমাপ্তি প্রত্যাশা করেননি।

হত্যার পর: লুকোচুরি, ধ্বংস ও নিথর দেহ

হত্যার পর ষড়যন্ত্রকারীরা এলাকা ত্যাগ করে। জিয়ার মৃতদেহ পড়ে থাকে সার্কিট হাউসের সিঁড়ির নিচে। ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন জেনারেল মঞ্জুর।

হত্যার পর সকাল সাড়ে ৯টায় মেজর শওকত আলী ও মোজাফফরের নেতৃত্বে জিয়াউর রহমানের মৃতদেহ কার্পেটে মুড়িয়ে সার্কিট হাউস থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। রাঙ্গুনিয়ার পাহাড়ের ঢালে অগভীর গর্তে তড়িঘড়ি দাফন করা হয়। পরে ১ জুন সকালে কর্নেল হান্নান শাহের নেতৃত্বে সেনা দল মৃতদেহ উদ্ধার করে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নিয়ে যান। সেখানে ডা. তোফায়েল আহমেদ ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন এবং মৃতদেহ ঢাকায় পাঠানো হয়।

বিচারপতি আব্দুস সাত্তার দায়িত্ব নেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে। সর্বত্র সমর্থন হারিয়ে মঞ্জুর সপরিবারে বান্দরবানের দিকে পালানোর সিদ্ধান্ত নেন। সঙ্গে ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাহবুব ও মেজর মোজাফফরের পরিবার। পথেই গাড়ি বিকল হলে আশ্রয় নেন ফটিকছড়ির এক পাহাড়ি পরিবারের বাড়িতে। কিন্তু অবস্থান ফাঁস হয়ে গেলে সেনাবাহিনীর অনুগত দলের গোলাগুলিতে মাহবুব ও মতিউর নিহত হন।

মঞ্জুর ধরা পড়েন এবং তাঁকে হাটহাজারী থানায় পুলিশ হেফাজতে আনা হয়। তাঁকে যেন সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়া না হয়,  বারবার এই অনুরোধ সত্ত্বেও সেনাবাহিনীর কাছেই হস্তান্তর করা হয় তাঁকে। নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রাম সেনানিবাসে।

সেখানে সেদিন রাতেই নিহত হন মঞ্জুর। সামরিক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, তিনি ‘বিক্ষুব্ধ সেনা সদস্যদের হাতে নিহত হয়েছেন’।  কিন্তু ময়নাতদন্তে ধরা পড়ে, মাথায় একটি বুলেটের আঘাতে মঞ্জুরের মৃত্যু হয়েছে। তাঁকে গোপনে দাফন করা হয়। 

জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর আগের ২৪ ঘণ্টা ছিল এক জটিল দৃশ্যপট। যেখানে একাকার হয়ে উঠেছিল আত্মবিশ্বাস, বিশ্বাসঘাতকতা, দলীয় সংকট, ব্যক্তিগত প্রতিশোধ ও সামরিক ষড়যন্ত্রের সংমিশ্রণ। চট্টগ্রামে যে সফর তাঁর দলের ঐক্য ফিরিয়ে আনার শেষ প্রচেষ্টা ছিল, সেটিই হয়ে উঠল তাঁর জীবনের অন্তিম অধ্যায়।

এ ঘটনা শুধু একটি হত্যাকাণ্ড নয়, এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গভীর মোড় পরিবর্তনকারী এক ট্র্যাজেডি, যার প্রভাব এখনো প্রাসঙ্গিক।

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment