×

কেন জৌলুস হারিয়েছিল শেরে বাংলার কৃষক প্রজা পার্টি

আজ বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের মৃত্যুদিন

মারুফ ইসলাম

কৃষকদের নিয়ে একটি সংগঠন আগে থেকেই ছিল। নাম—‘নিখিলবঙ্গ প্রজা সমিতি’। কিন্তু তা যেন নিখিল বাংলার কৃষকদের ভাগ্য পরিবর্তনে ‘যথাযথ’ ভূমিকা রাখতে পারছিল না। তাই শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ১৯২৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এ সমিতি থেকে বেরিয়ে যান ১৯৩৬ সালে।

যদিও নিখিলবঙ্গ প্রজা সমিতির পাঁচজন সহসভাপতির একজন ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকে। তারপরও তাঁর মনে হলো, তিনি কৃষকদের ভাগ্য পরিবর্তনে ঠিকমতো ভূমিকা রাখতে পারছেন না। এই বাংলার চিরদুঃখী কৃষকদের মুখে ফোটাতে হলে আলাদা একটি দল খুলতে হবে।

১৯৩৬ সালের জুলাই মাস। ঢাকায় ‘কৃষক প্রজা পার্টি’ নামে রাজনৈতিক দল খুললেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। সেটিই ছিল এই বাংলার কৃষকদের প্রথম রাজনৈতিক দল। শেরে বাংলাই প্রথম কৃষকদের রাজনৈতিক মর্যাদা দিলেন। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে ৩৬টি আসনও পায় কেপিপি তথা কৃষক প্রজা পার্টি। মাত্র এক বছর বয়সী একটি রাজনৈতিক দলের এই জনপ্রিয়তা তখন সবাইকে তাক তাগিয়ে দিয়েছিল।

তারপর নানা কারণে কৃষক প্রজা পার্টি তার জৌলুস হারিয়েছে। যেমন—মুসলিম লীগসহ অন্যান্য দলের সমন্বয়ে কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠন করা, মন্ত্রিসভায় কেপিপির নেতাদের যথেষ্ট গুরুত্ব না দেওয়া (মাত্র দুইজন মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছিল), শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ক্ষমতার প্রতি বেশি মনযোগী হয়ে ওঠা ইত্যাদি কারণ ছিল বলে মনে করা হয়।

দলের ভেতর ক্ষোভ, বিদ্রোহ, বহিষ্কার, পাল্টা বহিষ্কার—এসব চাড়াই উৎরাইয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে কেপিপি ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু হতে শুরু করে। শেষে ১৯৪৩ সালে দলটি প্রায় অস্তিত্বহীনন হয়ে পড়ে। তারপরও ধুঁকে ধুঁকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল কেপিপি। ওই বছরের নির্বাচনে মাত্র চারটি আসন পেয়েছিল কৃষক প্রজা পার্টি।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ঢাকায় চলে আসেন এবং ‘কৃষক শ্রমিক পার্টি’ নামে নতুন রাজনৈতিক দল খোলেন। আর এর মধ্য দিয়ে কৃষক প্রজা পার্টি (কেপিপি) পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায়।

সময়ের বিচারে মাত্র ১১ বছর বয়স ছিল কেপিপির, কিন্তু প্রভাব তৈরি করেছিল চিরকালীন। কারণ, কেপিপির হাত ধরেই বাংলায় জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়েছিল, কৃষক তার জমির একচ্ছত্র অধিকার ফিরে পেয়েছিল, খাজনার হার হ্রাস পেয়েছিল।

কৃষকদের ঋণ মওকুফ করেছিলেন কেপিপি নেতা শেরে বাংলা একে ফজলুল হক। ফলে মহাজনদের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পয়েছিল বাংলার কৃষকেরা। কৃষকদের মধ্যে তিনি সুদমুক্ত ঋণ চালু করেছিলেন। দেশজুড়ে খাল খনন করে সেচের সুবিধা বাড়িয়েছিলেন। আর জনমদুঃখী কৃষকের সন্তানেরা যাতে শিক্ষার আলো পায়, তাই বিনাবেতনে প্রাথমিক শিক্ষা চালু করাকে কেপিপির কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।

শেরে বাংলা এ কে বাংলা ফজলুল হক মারা গেছেন ১৯৬২ সালে। তারপর পেরিয়ে গেছে ৬৩ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে বাংলার কৃষকেরা আর একজনও শেরে বাংলা পাননি, যিনি কৃষকদের নিয়ে ভাববেন।

হ্যাঁ, বাংলার মানুষ কৃষি নিয়ে বড় বড় প্রজেক্ট পেয়েছে, কৃষির আধুনিকায়নের নামে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দের গল্প শুনেছে, কৃষি মন্ত্রণালয়ের শান–শৌকত বেড়েছে, কিন্তু কৃষকেরা যে তিমিরে ছিলেন, সেই তিমিরেই রয়ে গেছে।

আজ এই স্বাধীন বাংলায় কৃষকের ‘কল্যাণার্থে’ কৃষি ব্যাংক হয়েছে। তারা পাঁচ হাজার টাকা ঋণ পরিশোধ না করার ‘অপরাধে’ কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা করে। সেই মামলায় পুলিশ তাদের কোমরে দড়ি বেঁধে ধরে নিয়ে যায়!

কৃষকের সারে ভুর্তুকি দেওয়ার গল্প শোনায় স্বাধীন বাংলার সরকারেরা। আর সেই সারের জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে গুলি খেয়ে মরতে হয় কৃষককে!

শুধু ফসলের নায্য মূল্য না পেয়ে প্রতি বছর কত কৃষককে আত্মাহুতি দেন, তার খবর আসে না মিডিয়ার কানে। তবু মাঝে মাঝে যখন ‘পেয়াজ চাষি রুহুল আমিনের আত্মহত্যার’ মতো খবর আসে, তখন স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়।

এই মাত্র কয়েক দিন আগে রাজশাহীর বাঘার পেঁয়াজ চাষি রুহুল আমিন ট্রেনের নিচে শুয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন। সংবাদমাধ্যমের খবর বলছে, স্থানীয় তিনটি বেসরকারি সংস্থা থেকে যথাক্রমে ৫০ হাজার, ৬৪ হাজার ও ৮০ হাজার টাকা ঋণ করেছিলেন রুহুল আমিন। প্রতি সপ্তাহে তাঁকে ৪ হাজার ৪৫০ টাকা কিস্তি দিতে হতো। এখনো ৯৯ হাজার ২৯০ টাকা ঋণ অবশিষ্ট রয়েছে।

কিন্তু পেঁয়াজ চাষ করে ঋণ পরিশোধ করা তো দূর অস্ত, খরচের টাকাই তুলতে পারেননি মীর রুহুল আমিন। তাই জীবনের যাচনা সইতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন রুহুল আমিন।

এমন রুহুল আমিনের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। কে রাখে তার খবর! এই দুঃখীনি বাংলায় একজন শেরে বাংলার বড্ড প্রয়োজন।

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment