×

পলাশ সাহার আত্মহত্যা: দায়ী কে

মারুফ ইসলাম

আত্মহত্যাকে এত ছি ছি চোখে দেখার কিছু নেই। যেকোনো আত্মহত্যার পেছনে অন্তত তিনটি কারণ থাকে। ১. জৈবিক ২. মনস্তাত্ত্বিক ও ৩. ভৌগলিক। কেউ একজন আত্মহত্যা করলেই আমরা ধরে নিই, সে মানসিক সমস্যায় ছিল। এমন ভাবনা সত্যিই হাস্যকর।

মানসিক সমস্যা ছাড়াও মানুষের জীবনে আরও বহুবিধ সমস্যা থাকে। সেসব কারণেও মানুষ আত্মহত্যা করতে পারে। আবার কোনো সমস্যা ছাড়াই মানুষ আত্মহত্যা করতে পারে। কারণ, কোনো সমস্যা না থাকাও একটা বড় সমস্যা।

যাহোক, আত্মহত্যা নিয়ে গবেষণা করে সবচেয়ে বিখ্যাত হয়ে আছেন এমিল ডুর্খেইম নামের এক সমাজবিজ্ঞানী। ভদ্রলোক ফ্রান্সের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন। তিনি বলেছেন, যাঁরা সমাজের সঙ্গে অতিমাত্রায় সম্পৃক্ত, তাঁরা আত্মহত্যা করেন। আবার যাঁরা সমাজ থেকে অতিমাত্রায় বিচ্ছিন্ন, তাঁরাও আত্মহত্যা করেন।

আত্মহত্যার অন্তত তিনটি ধরন আছে। ১. আত্মকেন্দ্রিক আত্মহত্যা, ২. পরার্থপর আত্মহত্যা ও ৩. নৈরাজ্যমূলক আত্মহত্যা।

আত্মকেন্দ্রিক আত্মহত্যাকে সম্ভবত ব্যখ্যা করার কিছু নেই। যাঁরা নিজেকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করে, তাঁরাই সাধারণত আত্মকেন্দ্রিক আত্মহত্যা করে থাকে।

পরার্থপর আত্মহত্যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে, আত্মঘাতি হামলা। যাঁরা একটি বড় স্বার্থে কিংবা আদর্শের প্রয়োজনে আত্মঘাতী হন, তাঁদের পরার্থপর আত্মহত্যার উদাহরণ বলা যায়। যেমন আইএস যোদ্ধা, তালেবান যোদ্ধা, বিভিন্ন জঙ্গী গোষ্ঠীর সদস্য সমাজে একটি বৃহৎ আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে নিজে মরেন এবং সঙ্গে আরও অনেককে মেরে ফেলেন।

আর নৈরাজ্যমূলক আত্মহত্যা হচ্ছে, সমাজের ওপর যখন মূল্যবোধের কোনো প্রভাব থাকে না, চারদিকে শুধু বিশৃঙ্খলা, কেউ কাউকে মানেন না, সবাই নিজ ইচ্ছানুযায়ী চলেন, তখন এ নৈরাজ্যমূলক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। সাধারণত যুদ্ধ, বিপ্লব, বিপর্যয়, মহামারির পর এ ধরনের ঘঠনা ঘটে। ফরাসি বিপ্লবের পর ফ্রান্সে নৈরাজ্যমূলক আত্মহত্যা বেড়েছিল।

পলাশ সাহা নামের এক যুবক আত্মহত্যা করেছেন। পুলিশের বড় কর্মকর্তা ছিলেন। প্রচণ্ড মেধাবী। তাঁর আত্মহত্যা নিয়ে ব্যপক আলোচনা হচ্ছে।

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে জানা যাচ্ছে, গত ৭ মে দুপুরে চট্টগ্রামের চান্দগাঁওয়ে র‍্যাব-৭ ক্যাম্পে নিজের কক্ষ থেকে পলাশ সাহার মাথায় গুলিবিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ সময় পাশে একটি চিরকুটও পাওয়া যায়। র‍্যাবের ধারণা, নিজের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে পলাশ ‘আত্মহত্যা’ করেছেন। পলাশ সাহা ৩৭তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পুলিশে যোগ দিয়েছিলেন। র‍্যাবে তিনি সহকারী পুলিশ সুপার পদে কর্মরত ছিলেন। তাঁর বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার তাড়াশি গ্রামে।

পলাশ সাহার আত্মহত্যার পেছনে ‘বউ–শাশুড়ির দ্বন্দ্ব’সহ নানা কারণ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা চলছে। প্রশ্ন হচ্ছে, পলাশ আসলে কোন ধরনের আত্মহত্যা করেছিলেন? আত্মকেন্দ্রিক? পরার্থপর? না কি নৈরাজ্যমূলক?

সেটি ব্যখ্যা করার জন্য আমাদের সমাজের দিকে তাকাতে হবে। আমরা আসলে কোন সমাজে বাস করছি। সমাজটা কি নৈরাজ্যমূলক হয়ে উঠেছে? নাকি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে?

পরার্থপর হয়ে ওঠেনি এখনো, সেটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। সুতরাং ওই আলোচনা বাদ। আলোচনা করা যেতে পারে সমাজের নৈরাজ্য ও আত্মকেন্ত্রিকতা নিয়ে।

অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে দেশে যে নৈরাজ্য বেড়েছে, তা নিয়ে কারও দ্বিমত থাকার কথা নয়। যেকোনো বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে এটি ঘটেই থাকে। বাংলাদেশের সেটি ঘটেছে। খোদ পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরের ৪ মাসে ৫৫৩টি ডাকাতির ঘটনা, ৩০২টি অপহরণ এবং ৯৪৯টি চুরির ঘটনা পুলিশের কাছে নথিভুক্ত হয়েছে। যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ৩৯৬টি ডাকাতি, ১৬০টি অপহরণ ও ৮৫৯টি চুরির অভিযোগ পাওয়া গিয়েছিল।

এ ছাড়া ওই চার মাসে ৯৪৭টি খুনের ঘটনা থানায় রিপোর্ট করা হয়েছে। এই সংখ্যা ২০২৩ সালের একই সময়ের ৯৫৬টি খুনের ঘটনা থেকে সামান্য কম। তবে গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গণপিটুনিতে ২০২৪ সালে ১২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে আগস্ট থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ৯৬ জন। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ৫১।

এ সময়ের মধ্যে মাজার ও দরগায় বহু হামলার ঘটনা ঘটে। গত ২৩ জানুয়ারি, ‘গ্লোবাল সুফি অর্গানাইজেশন’ এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করে যে গত ৬ মাসে দেশজুড়ে ৮০টিরও বেশি মাজার ও দরগায় উগ্রবাদী গোষ্ঠী হামলা চালিয়েছে। সরকারি তথ্য বলছে, ৪ আগস্ট থেকে কমপক্ষে এরকম ৪০টি স্থাপনায় ৪৪ বার হামলা হয়েছে।

বর্ষীয়ান সমাজতাত্ত্বিক, রাজনীতিক ও লেখক বদরুদ্দিন ওমর সম্প্রতি গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্ররা এখন সবচেয়ে বেশি ব্যবসায়ী শ্রেণীর সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে পড়েছেন। ব্যবসায়ীরাই তাঁদের চালিয়ে যাচ্ছেন। এ অভ্যুত্থানের আগে তো এসবের কানাকড়িও ছিল না। অভ্যুত্থানের পর এতকিছু কোথা থেকে এল। এখন যেটি শোনা যায়, শুধু সাংগঠনিকভাবেই তাঁরা আয় করেছেন, এমন নয়। নিজেরাও অনেক টাকা আয় করে ফেলেছেন।

এসব তথ্য–প্রমাণ ও মন্তব্যের ভিত্তিতে নিঃসন্দেহেই বলা যায়, সমাজটা নৈরাজ্যমূলক হয়ে উঠেছে। এমন নৈরাজ্যমূলক একটি সমাজে ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ স্তরে থাকা পলাশ সাহা হঠাৎ করে আত্মহত্যা করে বসবেন, হঠাৎ করে আছিয়ার মতো কিশোরী ধর্ষণের শিকার হবেন, দিনে দুপুরে হঠাৎ ছিনতাইয়ের শিকার হবেন- এ আর নতুন কী? 

 

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment