পেঁয়াজচাষি রুহুল আমিন মরিয়া প্রমাণ করিলেন…
হাসান জামিল
রুহুল আমিন রাজশাহীর বাঘা উপজেলার কৃষক। ৭০ বছর বয়সী এই মানুষটিকে গত বুধবার খুব শান্তভাবে ট্রেনের নিচে শুয়ে পড়তে দেখা যায় এক ভিডিওতে। তিনি ট্রেনে কাটা পড়েন স্বেচ্ছায়। ভিউ-ব্যবসায়ীরা নানান আনুমানিক সুরতহাল করলেন ভদ্রলোকের শারীরিক-মানসিক-পারিবারিক ব্যাপারে। স্ত্রী মারা গেছেন, সন্তানরা নির্যাতন করেন। লোক খ্যাপানোর জন্য খুবই পপুলার এই অস্ত্র। পরিবারকে অপরাধী বানিয়ে কথা বলা।
একজন ফেসবুকে লিখলেন, ‘ওই বৃদ্ধের স্ত্রী আট মাস আগে মারা যান। এরপর দুই ছেলে ও দুই মেয়ে কিছুদিন বাবাকে রাখার পর আর রাখতে চাননি। এ নিয়ে অনেক ঝগড়া। এমনও রাত গেছে, বৃদ্ধ সারা রাত উঠানে ছিল, ছেলেরা দরজা খোলেনি। মৃত্যুর দিন সকালে দুই ছেলের বউয়ের সঙ্গে খুব ঝগড়া হয় এবং তাঁকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলে ছেলেরা তাঁর জিনিসপত্র উঠানে ফেলে দেন। এরপর স্টেশনে ভোর থেকে বসে ছিলেন তিনি। কিছু খাননি দুপুর পর্যন্ত। এরপর আত্মহত্যা করেছেন বলে জানা গেছে।’
কিন্তু পরে অনুসন্ধানে দেখা গেল আসলে ভিন্ন ব্যাপার! তার স্ত্রী আছেন, চার ছেলেমেয়ের রুহুলের সম্পর্কও ভালো।
গণমাধ্যমে আপাতত রুহুল আমিনের কয়েকটি সমস্যার কথা জানা গেছে। তার মানসিক স্বাস্থ্য ভালো ছিলো না। শারীরিক সমস্যাও ছিল। যদিও আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধান বেশ জটিল। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ব্যক্তিভেদে নানান বিষয় এর পেছনে কাজ করে।
খবরে জানা যায়, তিনি ব্যাক পেইনের রোগী ছিলেন। যাদের ব্যাক পেইন আছে, তারা জানেন, অসুখ হিসেবে এর ‘স্ট্যাটাস’ উঁচু না হলেও ভয়াবহ যন্ত্রণার। কোমরের সমস্যায় রুহুল হাঁটতেন বাঁকা হয়ে।
প্রথম আলো তাকে পেঁয়াজচাষি হিসেবে পরিচয় দিয়ে সংবাদ করেছে। তাদের শিরোনাম ছিল, ‘রাজশাহীতে পেঁয়াজচাষির আত্মহত্যা নেটিজেনরা ‘‘ধুয়ে দিচ্ছে” পরিবারকে, বাস্তবতা ভিন্ন’। আমরা তার এই পরিচয়টি নিয়ে বরং আগ্রহী।
‘বাংলাদেশে কৃষি-প্রধান দেশ’ শুনে আসছি সব সময়। কিন্তু এ দেশে কৃষি-বান্ধব পরিস্থিতি খুব কমই বিরাজ করে। এখানে সবচেয়ে গরিব মানুষটি কৃষক, সবচেয়ে কম সুবিধা এই পেশার মানুষদের। এমন কি কৃষক পরিচয়টিই একটি গরিবি ব্যাপার!
লেখক আলতাফ পারভেজ তার ‘ধান চাষের প্রতিবেদন’ বইয়ে কৃষকের ধান চাষ করে লাভের বদলে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াকে ‘কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তার মতে, এ ধরনের সহিংসতা কোনো ব্যক্তি দ্বারা সংগঠিত হয় না বলে এর শারীরিক ছবি থাকে না। এর উৎস ও প্রক্রিয়া অদৃশ্য থাকে। চলতে থাকে একটি প্রক্রিয়া আকারে, সামাজিক পরিস্থিতি ও ঐতিহাসিক পরম্পরা হিসেবে। এটি স্বাভাবিক ও ঐতিহাসিক নিয়তি হিসেবে আমরা মেনেও নিই এবং কৃষক এক অসম নাগরিক অভিজ্ঞতার শিকার হতে থাকেন।
সার, বীজ, সেচ, কৃষি যন্ত্র, বিদ্যুৎ-জ্বালানি ইত্যাদি মিলিয়ে ফসল তোলার আগেই চাষাবাদ ব্যয়বহুল হয়ে যাচ্ছে। কৃষক সেই তুলনায় দাম পাচ্ছেন না। এক পিঁয়াজচাষির সঙ্গে আমার কথা হয়। তিনি বলেন, পিঁয়াজের দাম ৫০ টাকার কম হলে কোনোভাবেই চাষের খরচ উঠবে না, লাভ তো দূরের ব্যাপার। কিন্তু খেয়াল করুন, এবারের রোজায় গত দেড় দশকের মধ্যে সব চেয়ে কম দামে ভোগ্য পণ্য, কৃষি পণ্য পাওয়া গেছে। খুবই ভালো কথা। মিডিয়াগুলো দাম কমের ব্যাপারটি রীতিমতো সেলিব্রেট করেছে। কিন্তু কৃষকের দিকটি বিবেচনা করেছে কেউ? কথা হয়েছে এই বিষয়ে? কতটা?
লেখক আরজু আহমেদ আজ তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে কৃষক রুহুল আমিনের আত্মহত্যা নিয়ে বলছিলেন, ‘…ট্রেনের নিচে শান্তভাবে শুয়ে পড়া ঐ বৃদ্ধ মানুষটার কথা বলতে গিয়ে অনেকে বলছেন, ‘‘এটা আমি”। আদতে এরচে বড়ো পরিহাস আর হয় না আসলে। শহুরে বিষণ্নতা আর প্রান্তিক কৃষকের দুঃখে অনেক তফাৎ।
ফসলের দাম কম হওয়ায় ভোক্তা খুশি হয়, কিন্তু উৎপাদন খরচ না কমলে তো কৃষকের পক্ষে স্বল্প মূল্যে পণ্য বেচাটা রক্ত বিক্রি করার মতোই। রাষ্ট্রকে অবশ্যই ভর্তুকি দিতে হবে। কৃষক না বাঁচলে দেশ আগাবে না।’
আরজু আহমেদের সঙ্গে কৃষি পণ্যের দাম নিয়ে এই রমজানে আমার আলাপ হয়। তখন মরিচের কেজি ছিল ৩০ থেকে ৪০ টাকা, এটা নিয়ে আমরা রীতিমতো বিরক্তই হই। এভাবে কৃষক বাঁচতে পারে না। বাজারে এসব পণ্যের একটা ন্যূনতম মূল্য বেঁধে দেওয়া উচিত। এক কেজি মরিচ তুলতে কৃষকের কয়েক শ মরিচ লাগে। শুধু হারভেস্টিংয়ের সময় কতবার মরিচ ধরে বস্তা বা ঝুড়িতে রাখতে হয়, ভেবেছেন? অন্য সব বাদই দেন। সেই মরিচের কেজি ৩০-৪০ টাকা হলে কৃষক কত পান? সব কৃষি পণ্যের বাজারেই মূলত মধ্যস্বত্বভোগীদের দখলে। যিনি চাষ করেন, তিনি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিতে থাকেন, বেশি দামে কিনে ঠকেন ক্রেতা—লাভের গুড়ে গুদাম ভরেন মধ্যস্বত্বভোগীরা।
আমাদের এখানে কোনো ধরনের সুস্থ বাজারব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। নাই সুষ্ঠু সাপলাই চেইন। কাঠামোবদ্ধ সহিংসতার এটি বড় কারণ। আমাদের পাশের দেশ ভারতে কৃষকের আত্মহত্যার খবর হামেশাই দেখা যায়। আমাদের দেশে এটি কম হলেও, রহুল আমিনদের এই ঘটনা বিরল নয়। অতি পরিশ্রম, দারিদ্র্য, খেতে বিষ প্রয়োগে স্বাস্থ্যহানি, স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতার কারণে কম বয়সে কৃষকের মৃত্যুর বিষয়টি আলোচনায় নাই বললেই চলে।
কৃষক রুহুল আমিনের ‘কোমর বাঁকা’ তো বাংলাদেশের কৃষকের স্বাস্থ্যের প্রতিকমাত্র! সারা জীবনের পরিশ্রম আর স্বাস্থ্যসেবা থেকে দূরে থাকার বিষয়টি সহজেই অনুমেয়। তাঁর আত্মহত্যা যেন এসব মিলিয়েই। আজ সংস্কারের বাড়বাড়ন্তির এই সময়ে আপনি বাংলাদেশের কৃষি নিয়ে কোনো সংস্কারের কথা শুনবেন না। অথচ এটাই বাংলাদেশের মেরুদণ্ড। বাংলাদেশের মূল শক্তি। করোনার সময় সব যখন বন্ধ, কৃষক কিন্তু থামেননি এক দিনের জন্যও। ফলে এই খাতের সংস্কারের কথাও আপনারা ভাবেন। কৃষক রুহুল আমিনের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে হলেও পুরো কৃষিব্যবস্থার দিকে নজর ফেরান। নইলে আমরা হয়তো তাঁর মতো আত্মহত্যা করারও সুযোগ পাব না, আমাদের না খেয়েও মরতে হতে পারে।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment