যে কারণে রাখাইন করিডর নিয়ে বিতর্ক
গৃহযুদ্ধে পর্যদুস্ত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। এ বছর রাখাইনে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ। তাই সংস্থাটি এই অঞ্চলে মানবিক সহায়তা পাঠাতে বাংলাদেশের সাহায্য চায়। আর এর অংশ হিসেবে একটি ‘মানবিক করিডর’ স্থাপনের কথা বলা হচ্ছে।
জাতিসংঘ বলছে করিডর করে ত্রাণ পাঠানো না হলে মানবিক সংকট বাড়বে। এতে আরও বেশি সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করবে।
গত মার্চে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ সফর করেন। তখন তিনি রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে একটি করিডর তৈরির প্রস্তাবনা দেন। এই করিডর দিয়ে রাখাইনের বেসামরিক নাগরিকদের জন্য ত্রাণসহ অন্যান্য মানবিক সহায়তা পাঠানো হবে।
গত ২৭ এপ্রিল, রবিবার বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জানান, এই মানবিক করিডর তৈরির ব্যাপারে সরকার নীতিগত সম্মতি জানিয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এতটুকু আপনাদের বলতে পারি, নীতিগতভাবে আমরা এতে সম্মত। কারণ, এটি একটি হিউম্যানিটেরিয়ান প্যাসেজ (ত্রাণ পৌঁঁছানোর পথ) হবে। কিন্তু আমাদের কিছু শর্তাবলি রয়েছে, সেই বিস্তারিততে যাচ্ছি না। সেই শর্তাবলি যদি পালিত হয়, আমরা অবশ্যই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করব।’
মানবিক করিডর কী?
মানবিক করিডর হলো যুদ্ধরত পক্ষগুলোর মধ্যে একটি সাময়িক চুক্তি, যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একটি এলাকায় নিরাপদে চলাচলের সুযোগ দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষ এলাকা ছাড়তে পারে, ত্রাণ পৌঁছাতে পারে, অথবা আহত ও নিহতদের সরিয়ে নেওয়া যায়।
বসনিয়া হয়ে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ থেকে শুরু করে ইউক্রেন- সবখানেই মানবিক করিডর ব্যবহৃত হয়েছে।
বাংলাদেশের নিরাপত্তা ঝুঁকি কতটুকু?
প্রশ্ন উঠছে, এই করিডর তৈরির ফলে বাংলাদেশ নিজে কতটুকু নিরাপদ থাকবে? বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বের নানা দেশে এমন করিডর বিদ্রোহীরা ব্যবহার করেন। কারণ এই পথ ব্যবহার তুলনামূলক নিরাপদ। সেইসাথে মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানসহ বিভিন্ন অবৈধ কাজে এই রুট ব্যবহৃত হতে পারে।
বর্তমানে রাখাইন রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে আরাকান আর্মি। কেন্দ্রের জান্তা সরকার এদের স্বীকৃতি দেয়নি। তাই এদের সঙ্গে আলোচনা জান্তা সরকার কীভাবে নেবে তা নিয়েও সন্দিহান বিশ্লেষকরা। তাছাড়া আরকান আর্মিকে কোণঠাসা করতে রাখাইন রাজ্যে ত্রাণ আসার সব পথ আটকে রেখেছে জান্তা সরকার। এই পরিস্থিতিতে করিডর দিয়ে ত্রাণ গেলে তা সাধারণ মানুষের চাইতে বিদ্রোহীদের হাতে পৌঁছানোর সম্ভাবনাই বেশি।
বিকল্প করিডরের খোঁজ
বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো পথে এ করিডর বানানো যায় কি না, সেটি নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলছেন, বাংলাদেশের বিকল্প হিসেবে মিয়ানমারের সিতওয়ে বন্দর ও বঙ্গোপসাগরের মিয়ানমার উপকূলের বেশ কিছু জায়গা ব্যবহৃত হতে পারে।
তবে গত ৮ এপ্রিল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং রোহিঙ্গা সমস্যাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান জানান, রাখাইনে মানবিক সহায়তা পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ হচ্ছে একমাত্র চ্যানেল, যার মাধ্যমে এটা করা সম্ভব। কারণ, রাখাইনের উপকূল এখনও জান্তা বাহিনীর দখলে এবং অন্যান্য জায়গা দিয়ে সহজে ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব নয়।’
রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য
মানবিক করিডরের বিষয়ে সরকারের নীতিগত সম্মতির পরদিন ঠাকুরগাঁওয়ে এক পথসভায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা আরেকটা গাজায় পরিণত হতে চাই না। আর যুদ্ধ দেখতে চাই না। আরাকানদের সঙ্গে যোগাযোগের জন হিউম্যানিটিরিয়ান প্যাসেজ নিয়ে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল।’
২৯ এপ্রিল, মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মামুনুল হক সরকারি এ নীতিগত সম্মতির প্রতিবাদ জানান।
এদিকে রোহিঙ্গাদের জন্য স্বাধীন আরাকান রাজ্য চেয়েছে জামায়াত। ঢাকা সফররত চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে এ দাবি জানিয়েছেন দলটির নেতারা।
বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, ‘বাংলাদেশে ১১ বা ১২ লাখ রোহিঙ্গা আছে; তারা মানবেতর জীবন যাপন করছে। তাদের খাদ্য, কাপড় ইত্যাদি দেওয়া কোনো সমাধান নয়। স্থায়ী সমাধানের জন্য রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ ভূমিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া ও পুনর্বাসন করতে হবে। সে জন্য আমরা আরাকানকেন্দ্রিক সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গাদের এলাকায় “ইন্ডিপেনডেন্ট আরাকান স্টেট” করার প্রস্তাব দিয়েছি।’
ভিন্ন সুর প্রেস সচিবের
পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্যের দুই দিন পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, করিডর দেওয়ার বিষয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারের আলোচনা হয়নি।
ইউএনবির এক প্রতিবেদন তিনি বলেন, ‘আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, জাতিসংঘ বা অন্য কোনো সংস্থার সঙ্গে তথাকথিত ‘মানবিক করিডোর’ নিয়ে কোনো আলোচনা করেনি সরকার। আমাদের অবস্থান হলো- যদি জাতিসংঘের নেতৃত্বে রাখাইনে মানবিক সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়, তবে বাংলাদেশ সেক্ষেত্রে যৌক্তিক সহায়তা দিতে প্রস্তুত।’
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment