বিজ্ঞাপনে ঢেকে যাচ্ছে ক্রিকেটারদের জার্সি, ভবিষ্যতে কি আরও বাড়বে?
সজিব মিয়া
আজকাল ক্রিকেট মাঠে ক্রিকেটারদের বুকে-পিঠে-কাঁধে-মাথায় সর্বত্রই দেখা যায় বিচিত্র সব কোম্পানির লোগো। তার সংখ্যা এত বেশি যে খেলোয়াড়দের নাম, যা আগে পিঠে লেখা থাকত, তা এখন থাকে কোমরের কাছাকাছি। ক্রিকেটে স্পন্সরশিপের এই দৌরাত্ম নতুন কিছু নয়। এই প্রবণতা সারা বিশ্বেই রয়েছে। দিন যত যাচ্ছে, কিক্রেট যত জনপ্রিয় হচ্ছে, এর বাণিজ্যিক ক্ষেত্র তত বাড়ছে। ক্রিকেটের বাণিজ্যিক বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই। ফলে ক্রিকেটে স্পন্সরশিপের দৌরাত্ম ভবিষ্যতে কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা অনুমান করাও কঠিন।
যেভাবে করপোরেট হয়ে উঠল বাংলাদেশের ক্রিকেট
বর্তমানে বাংলাদেশে দর্শকপ্রিয়তার দিক থেকে ক্রিকেট সবথেকে জনপ্রিয় খেলা। ক্রিকেটীয় উন্মাদনা এখন ঘরে ঘরে দেখা যায়। ক্রিকেটাররা এখন দেশের সব থেকে বেশি উদযাপিত, আলোচিত, সমালোচিত ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। যেসব কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান ক্রিকেটারদের দিয়ে বিজ্ঞাপন করায়, তাদের ব্যবসাও বেশ রমরমা। বাংলাদেশের ক্রিকেটের বর্তমান অবস্থা (যদিও সেটা ভালো অবস্থান কিনা সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে) একদিনে হয়নি, অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে এই পর্যায়ে আসার জন্য।
ঘটনার শুরু বলা যায় ১৯৮৩ সালে, যখন কে জেড ইসলাম (কামাল জিয়াউল ইসলাম) বিসিবির সভাপতি হলেন তখন। তিনিই প্রথম পদক্ষেপ নেন দেশের স্কুল ক্রিকেটকে সমৃদ্ধ করার। তিনি ‘নির্মাণ স্কুল’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান করেন যেটি স্কুল ক্রিকেটকে প্রতিষ্ঠা করতে ব্যাপক ভুমিকা রাখে সেসময়। এক সময় বাংলাদেশ দলের অনেক নামীদামী খেলোয়াড়রা এই স্কুল ক্রিকেট থেকেই উঠে আসত। তাঁর আমলেই বাংলাদেশ দল প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে অংশগ্রহণ করে ১৯৮৬ সালের এশিয়া কাপে। তারপর কেটে গেছে প্রায় চল্লিশ বছর, দেশের ক্রিকেটও এখন বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।
দিন দিন দেশের ক্রিকেটের পরিধি বড় হচ্ছে, ক্রিকেটের সঙ্গে নানা ধরণের স্পন্সর প্রতিষ্ঠান যুক্ত হচ্ছে, ক্রিকেটারদের সঙ্গে ব্যক্তিগত চুক্তিও হচ্ছে বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর বিজ্ঞাপন, টিভিসিতে দেশের ক্রিকেটারদের অংশগ্রহণ এখন খুবই স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। গত বছর টেলিকমিউনিকেশন প্রতিষ্ঠান ‘রবি’ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে ৫০ কোটি টাকার স্পন্সরশিপ চুক্তি করেছে।
বাংলাদেশ ২০০০ সালে আইসিসির সদস্যপদ লাভ করে, যদিও ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই এই অঞ্চলে ক্রিকেটের প্রচলন শুরু হয়। কিন্তু একদম শুরুর দিকে বাংলাদেশ দল ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ হতে থাকে যার প্রভাব ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে দেখা যায়। ২০০৩ সালেই বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সঙ্গে যুক্ত হয় গ্রামীণফোন এবং তারা দেশের ক্রিকেটের উন্নতিতে ভূমিকা রাখা শুরু করে। অবকাঠামোগত বিভিন্ন বিষয়ের উন্নতি, ক্রিকেটের প্রচার ও প্রসার ঘটানোর ক্ষেত্রে গ্রামীণফোনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
স্পন্সরশিপের শুরু আড়াই হাজার বছর আগে
পৃথিবীতে স্পন্সরশিপের বিষয়টি নতুন কোনো বিষয় নয়, প্রায় ২৫০০ বছর আগে থেকেই এটি প্রচলিত। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটির ধরণে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ৫ শতকে গ্রিসে সর্বপ্রথম স্পন্সরশিপের বিষয়টি শুরু হয়। শুরুতে এটি ধনী ব্যক্তিদের বিভিন্ন প্রতিযোগীতায় যেগুলোতে জনসমাগম রয়েছে, সেগুলোতে করতে দেখা যেত। এরপর মূলত রেনেসাঁর সময়ে স্পন্সরশিপের বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচলিত হতে থাকে। তবে করপোরেট স্পন্সরশিপের বিষয়টি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে যায় যখন মিডিয়ার প্রচলন শুরু হয়। ১৯৮০-১৯৯০ এর দিকে করপোরেট স্পন্সরশিপের বিষয়টি পুরো পৃথিবীতে ব্যাপকভাবে শুরু হয়।
বর্তমানে ভোক্তাদের বাজার এবং পণ্যের প্রচারণার একটি অন্যতম মাধ্যমে হচ্ছে স্পন্সরশিপ। রিসার্চ অ্যান্ড মার্কেট ডটকমের গবেষণায় দেখা যায়, পুরো পৃথিবীতে গত বছর বিভিন্ন খেলায় স্পন্সরশিপের পরিমাণ ছিল ৬৬ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। এটি চলতি বছরে ৭০ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২৯ সালে এটি ৯০ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করছে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে করপোরেট স্পন্সরশিপের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড বলছে, গত বছর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে মোবাইল টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি ‘রবি’ ৫০ কোটি টাকার চুক্তি করেছে এবং দলের অফিশিয়াল স্পন্সর হিসেবে যুক্ত হয়েছে।
স্পন্সরশিপ কী
স্পন্সরশিপ বলতে খেলায় আর্থিক সহায়তাকে বোঝায়, যা মূলত বাইরের কেউ (ব্যক্তি হতে পারে বা সংস্থাও হতে পারে) করে থাকে। এখানে উভয়পক্ষের লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকে।
স্পন্সরশিপ বিভিন্ন ধরনের হয়। যেমন, ব্যক্তিকেন্দ্রিক অথবা দল ও ক্লাবকেন্দ্রিক। ব্যক্তিকেন্দ্রিকের ক্ষেত্রে খেলোয়াড়কে স্পন্সর করা প্রতিষ্ঠানের প্রতীক (লোগো) অথবা একটি নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের জিনিসপত্র পরিধান করতে হয়। এ ছাড়া খেলোয়াড়দের ট্রেনিং, প্রতিযোগিতা ও যাতায়াত খরচও দিয়ে থাকে স্পন্সর প্রতিষ্ঠান।
অন্যদিকে দল বা ক্লাবের ক্ষেত্রে স্পন্সর প্রতিষ্ঠানের দেওয়া কিট বা জার্সি দলের সবাইকেই পরতে হয়। কখনো কখনো স্পন্সর প্রতিষ্ঠানের ব্যানারও প্রদর্শন করতে হয়। এ ছাড়া দলের নামের সঙ্গে স্পন্সরের নাম যুক্ত করা হয়। কখনো কখনো স্পন্সর প্রতিষ্ঠানের নামে স্টেডিয়ামও করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিযোগিতার এবং যাতায়াতের খরচ স্পন্সরশিপ প্রতিষ্ঠান বহন করে।
বিসিবি ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যেভাবে চুক্তি হয়
মূলত যাঁরা বিসিবির পরিচালনা পরিষদের দায়িত্ব পালন করেন তাঁরাই বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির বিষয়গুলো দেখেন। এ বিষয়ে বিসিবি থেকে টেন্ডার নোটিশ দেওয়া হয় কোনো বড় সিরিজ অথবা টুর্নামেন্টের শুরুর আগেই।
গত বছর মোবাইল টেলিকমিউনিকেশন প্রতিষ্ঠান রবির সঙ্গে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের ৫০ কোটি টাকার যে চুক্তি হয়েছে, সেখানে প্রতিষ্ঠানটি বেশ কিছু শর্ত আরোপ করেছে।
বাংলা ট্রিবিউনের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৫ সালে রবির সঙ্গে ৪১ কোটি ৪১ লাখ টাকার চুক্তি করেছিল বিসিবি, কিন্তু ২০১৮ সালে সেই চুক্তি তারা বাতিল করে দেয়। কারণ হিসেবে জানা যায়, জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা অন্য টেলিকমিউনিকেশন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির বাইরে গিয়ে যুক্ত হয়েছেন। তাদের সঙ্গে করা নতুন চুক্তিতে টেলিকমিউনিকেশন প্রতিষ্ঠানটি শর্ত দিয়েছে, চুক্তি চলাকালীন জাতীয় দলের কোনো খেলোয়াড় অন্য কোনো টেলিফোন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিতে যুক্ত হতে পারবেন না। আর যারা বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চুক্তিতে যুক্ত আছেন তারা চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে নতুন করে আর চুক্তি করতে পারবেন না। তবে খেলোয়াড়রা মোবাইল কোম্পানির বাইরে যদি অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেন, সে ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবে না।
স্পন্সরশিপ ক্রিকেটের জন্য ভালো নাকি খারাপ
বাংলাদেশের ক্রিকেটে কোকা-কোলা ও বিমান বাংলাদেশ শুরু থেকেই স্পন্সর করেছে। ২০০৩ সালে গ্রামীণফোন প্রথম করপোরেট অফিশিয়াল স্পন্সর হিসেবে যুক্ত হয়। এরপর ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন বড় বড় প্রতিষ্ঠান এখানে যুক্ত হয়েছে।
করপোরেট স্পন্সরশিপের কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে। যেমন, ২০০৬ সালে বিসিবি ও গ্রামীণফোন একটি ক্যাম্পেইন চালু করে যার টাইটেল ছিল—‘আমাদের রক্তে ক্রিকেট’। ক্রিকেটকে একটি জাতীয় খেলা হিসেবে পরিচিত করার ব্যাপারেও এদের ভূমিকা রয়েছে।
গ্রামীণফোন মিরপুরে বিশ্বমানের ক্রিকেট একাডেমি তৈরি করে দিয়েছে যেখানে দেশের খেলোয়াড়রা বিশেষ প্রশিক্ষণ সুবিধা পায়। বাংলাদেশের ক্রিকেটকে প্রান্তিক অঞ্চলে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে গ্রামীণফোনের ভূমিকা রয়েছে। এ ছাড়া দলের সেরা খেলোয়ারদের প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে যুক্ত করে যুব সমাজের মধ্যে ক্রিকেটের উন্মাদনা তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে।
২০০৩ সালের জুলাইয়ে গ্রামীণফোন ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকার চুক্তিতে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অফিশিয়াল স্পন্সর হিসেবে যুক্ত হয়, যার ১৫ শতাংশ ক্রিকেটারদের জন্য বরাদ্দ ছিল। এ ছাড়াও এই কোম্পানি দলের জার্সি, যাতায়াত ব্যবস্থা এবং নিজেদের অপারেটরের মোবাইল সংযোগ সুবিধা প্রদান করে। ২০১১ সাল পর্যন্ত গ্রামীণফোন ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটের অফিশিয়াল স্পন্সর।
এরপর ২০১২ সালে ৭০ কোটি টাকার বিনিময়ে সাহারা গ্রুপ স্পন্সর হিসেবে যুক্ত হয় চার বছরের জন্য। এরপর ২০১৫ সালে মোবাইল টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি রবি ৪১ কোটি ৪১ লাখ টাকার বিনিময়ে স্পন্সর হিসেবে যুক্ত হয়। ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই চুক্তি ছিল। পরে ২০২৪ সালে আবার তারাই ৫০ কোটি টাকায় বর্তমানে স্পন্সর হিসেবে যুক্ত আছে।
ভবিষ্যতে স্পন্সরশিপ কি আরও বাড়বে?
ক্রিকেটে স্পন্সরশিপের এই প্রবণতা সারা বিশ্বেই বাড়ছে। ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আসর ভারতের আইপিএলে স্পন্সরশিপের রমরমা দেখলে চোখ কপালে উঠবে। এ নিয়ে বিরক্তও অনেক ক্রিকেট ভক্ত।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির ক্রীড়া সাংবাদিক এ্যালিসন মিচেল বলেন, ‘আইপিএলে অনেক খেলোয়াড় আছে যারা ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে আইপিএলে খেলতে এসেছে। আমি তাদের নাম জানতে চাই—কিন্তু তার জার্সিতে তার নামটাই দেখতে পাই না, দেখছি লেখা আছে জেপি সিমেন্টস, বা ডিজে ফেন্সিং বা অন্য কিছু। দয়া করে খেলোয়াড়দের নামটা জার্সির পিঠে দিন, তার কোমরের কাছাকাছি নয়। ক্রিকেট ভক্তরা তাদের প্রিয় খেলোয়াড়ের নাম দেখতে চায়। বুকে-পিঠে-কাঁধে এই স্পন্সরদের নামগুলো কি বাদ দেয়া যায় না?’
এর উত্তর দিয়েছেন আরেক ভারতীয় সাংবাদিক বোড়িয়া মজুমদার। তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘খেলোয়াড়দের জার্সি থেকে স্পন্সরদের নাম বাদ দেওয়ার আর উপায় নেই। এখানে এত বেশি টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে যে কোনো আপত্তিতেই লাভ হবে না। এটাই ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ। আইপিএলে এখন এক একটি দলের পেছনে শত কোটি টাকার বেশি খরচ হয়। এত টাকা কে দেবে? স্পন্সরের লোগো বাড়ানো ছাড়া উপায় আছে? ফলে ভবিষ্যতে ক্রিকেটারতের জার্সিতে স্পন্সরদের লোগো আরও বাড়বে বৈ কমবে না।’
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment