×

ভারত-পাকিস্তান সংঘাত: কী বার্তা দিচ্ছে দুই দেশের গণমাধ্যম

যুদ্ধ সব সময় বহুস্তরে হয়ে থাকে। পাড়ার চা-দোকান থেকে শুরু করে সেনানিবাস, ক্লাব থেকে প্রধানমন্ত্রীর অফিস, আড্ডা থেকে বাজারের ব্যাগ—যুদ্ধ হয় সর্বব্যাপী। যুদ্ধক্ষেত্রের আক্রমণ, প্রতি-আক্রমণ, যে খেলা জল-স্থল-অন্তরীক্ষে চলে—তার বাইরে যুদ্ধ চলে বহু ক্ষেত্রে। আর সেই ক্ষেত্রের অন্যতম হলো সংবাদমাধ্যম। দুই দেশে যুদ্ধ হলে বেশিরভাগ সময়েই গণমাধ্যম তার নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হিমশিম খায়। কিছু ব্যতিক্রম যে হয় না, তা নয়। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের এখনো ২৪ ঘণ্টা পার হয়নি। এর মধ্যে দুই দেশের গণমাধ্যম তাদের জাতীয়তাবাদী চেহারায় হাজির হয়েছে অনেকটাই। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ঘেঁটে জানাচ্ছেন শতাব্দীকা ঊর্মি

সম্প্রতি কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নতুন করে সামরিক উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। দুই দেশের গণমাধ্যম এই ঘটনাকে নিজস্ব রাজনৈতিক ও সামরিক অবস্থান অনুযায়ী উপস্থাপন করছে, যার মধ্যে শুধু সংবাদ নয়; বরং এর মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হচ্ছে দুই দেশের জাতীয়তাবাদী মনোভাব, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য।

যা বলছে পাকিস্তানি গণমাধ্যম

পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ডন’-এর তথ্যমতে, পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠকে ভারতের ‘অবৈধ কর্মকাণ্ড’কে ‘পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন’ হিসেবে নিন্দা করা হয়েছে, যাকে আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে ‘যুদ্ধ’ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই শীর্ষ নিরাপত্তা বৈঠকে চিফ অব জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ কমিটি জেনারেল সাহির শমশাদ মির্জা, আইএসআই মহাপরিচালক জেনারেল আসিম মালিক ও সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

এ ছাড়াও ‘দ্য পাকিস্তান টুডে’ জানাচ্ছে, পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীকে ভারতের হামলার জবাব দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমে প্রতিরোধের গল্প, এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বীরত্বের প্রচার দেখা যাচ্ছে। তাদের কভারেজ জাতীয়তাবাদী আবেগে পূর্ণ থাকে, যেখানে ভারতের অভিযানের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের জবাবকে তুলে ধরা হয়।

যা বলছে ভারতীয় গণমাধ্যম

ভারতের সংবাদমাধ্যম ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ অনলাইন শিরোনাম করেছে, ‘ভারত স্পষ্ট করে জানিয়ে দিল, সন্ত্রাসীরা নারীদের “ছাড়” দিলেও ভারতের নারীরা তাদের ছাড়বে না’
টেলিগ্রাফ আরও জানাচ্ছে, অপারেশন ‘সিঁদুর’-এর আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে কর্নেল সোফিয়া কুরেশি এবং উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিংহের নেতৃত্ব শুধু প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে লিঙ্গ-প্রতিনিধিত্বের জন্যই যুগান্তকারী মুহূর্ত নয়, পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক বক্তব্যেরও শক্তিশালী জবাব।

গণমাধ্যমটি বলছে, ভারতীয় বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার পাইলট উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিংহ ইংরেজিতে সাংবাদিকদের উদ্দেশে ভাষণ দেন।

দুই নারী অফিসারকে সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে বেছে নেওয়া হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে, যা ভারতের কৌশলগত যোগাযোগের অংশ। বার্তাটি ছিল জোরালো ও স্পষ্ট, দেশের প্রতিক্রিয়ার অগ্রভাগে নারীরা।

‘দ্য নিউজ লন্ড্রি’ জানাচ্ছে, টার্গেট নির্বাচনের থেকে শুরু করে প্রেস ব্রিফিং পর্যন্ত, পহেলগামের ঘটনায় এটা ছিল ভারতের জবাব। যেসব জায়গায় হামলা হয়েছে সেগুলো কোনোটিই বেসামরিক স্থান নয় বলে জানান ব্যোমিকা সিং। আবার ভারতীয় কিছু চ্যানেলে দেখা গেছে যুদ্ধবিমানের অ্যানিমেশন এবং বিস্ফোরণের দৃশ্য, যেখানে সংবাদ উপস্থাপকেরা “অপারেশন সিদুঁর”-এর খবর দিচ্ছিলেন, পাকিস্তান এবং পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরে ভারতের সামরিক অভিযানের সরকারি নাম।

ভারতের প্রায়ই উচ্চকণ্ঠ এবং আক্রমণাত্মক মিডিয়ার মধ্যে এমন উগ্র জাতীয়তাবাদী মনোভাব নতুন নয়, যাকে প্রায়শই সরকারের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়।

মোদি এমন একটি গর্বিত, জাতীয়তাবাদী জাতিকে নেতৃত্ব দিতে চান, যা কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলায় নিজের ক্ষমতার ওপর আস্থা রাখে। ভারত-অধিকৃত কাশ্মীরে পর্যটক হত্যাকাণ্ডের পর অনেক সংবাদমাধ্যম তাৎক্ষণিকভাবে “প্রতিশোধের” ডাক দিয়েছিল।

আবার ‘দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া’ থেকে জানা যায়, মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘অপারেশন সিদুঁর’কে গর্বের মুহূর্ত হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’-এর ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।

গত ২২ এপ্রিল ভারত-শাসিত কাশ্মীরের পহেলগামের সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ২৬ জনের সবাই পুরুষ ছিলেন। এদের মধ্যে কয়েকজন সদ্যবিবাহিতও ছিলেন। এই পরিপ্রেক্ষিত এই অভিযানের নাম রাখা হয়েছে ‘সিদুঁর’। কেন অভিযানটির নাম ‘অপারেশন সিঁদুর’ রাখা হলো, ভারতীয় গণমাধ্যমে আছে তার ব্যাখ্যাও। তারা বলছে, এই নাম বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, পেহেলগামের হামলায় সদ্যবিবাহিত নৌসদস্য লেফটেন্যান্ট বিনয় নারওয়ালের মৃত্যু হয়, মুছে যায় তাঁর স্ত্রীর সিঁথির সিঁদুর। স্বামীর মঙ্গল কামনায় হিন্দু বিবাহিত নারীরা সিঁথিতে সিদুঁর পরেন।

উভয় দেশের অনেক সংবাদমাধ্যম সরকারের অবস্থানকেই সরাসরি প্রতিফলিত করে। সাংবাদিকতার স্বাধীনতার চেয়ে “দেশপ্রেম”-কে বড় করে দেখা হয়। ফলে সমালোচনামূলক বা বৈচিত্র্যময় মতামতের জায়গা ছোট হয়ে আসে। যুদ্ধবিরোধী কণ্ঠ বা শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বানকে প্রায়শই “দেশদ্রোহিতা” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

পাকিস্তান ও ভারতীয় গণমাধ্যমের পাশাপাশি এই দুই দেশ আজ বিশ্বের অন্যান্য মাধ্যমেও উঠে এসেছে ভারত-পাকিস্তান।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সিএনএনের এক প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ভারতের হামলার সংবাদ পরিবেশনায় জাতীয়তাবাদী সুর প্রকট। নয়াদিল্লির পাকিস্তানের উপর হামলার পর থেকে ভারতের অনেক সংবাদ চ্যানেলের কভারেজে প্রবল জাতীয়তাবাদী বক্তব্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

সিএনএন আরো জানিয়েছে, একটি সংবাদ চ্যানেলের শিরোনাম ছিল “ভারত শত্রুকে চূর্ণ করল”। আরেকটি শিরোনাম বলছিল “ভারতের শক্ত আঘাত পাকিস্তানের ওপর”। একটি সংবাদ সংস্থা একটি ছবি প্রকাশ করেছিল, যেখানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ক্যাপ্টেন আমেরিকার মতো ঢাল হাতে দেখানো হয়েছে, ঢালটি ভারতের জাতীয় পতাকার রঙে রাঙানো।

একদিকে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সংবাদমাধ্যম জনসচেতনতা বাড়াতে, তথ্য সরবরাহ করতে এবং সরকারের নীতিমালা ব্যাখ্যা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে, যখন তারা উত্তেজনা, ঘৃণা, এবং প্রতিশোধপরায়ণতা উসকে দেয়, তখন সেই মিডিয়ার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বহু শান্তিপ্রিয় মানুষ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী আছেন যারা সংঘাতের পরিবর্তে আলোচনার পক্ষে। কিন্তু এই কণ্ঠগুলো মূলধারার সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই যথেষ্ট জায়গা পায় না। যুদ্ধমুখী বা “চলছে যুদ্ধ” ধরনের কভারেজ তাদের আওয়াজকে ম্লান করে দেয়।

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment