ভারত-পাকিস্তান সংঘাত: প্রতিশোধ নাকি নদী নিয়ন্ত্রণের কৌশল
কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা কেন্দ্র করে পাক-ভারত যুদ্ধের ফলাফল নিয়ে অনেক ধরণের সমীকরণ কিংবা উদ্বেগ থাকলেও একটি বিষয়ে সবপক্ষই মোটামুটি একমত। তা হলো, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো পাক-ভারত যুদ্ধে কেউই অন্য দেশের ভূমি দখলের চেষ্টা করছে না। তাহলে প্রশ্ন হলো, চির প্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রতিবেশী এই দুই দেশ এমন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করছেই-বা কেন? কী হাসিল করতে? ভারত ও পাকিস্তান দেশ দুটির উৎপত্তি আর ভৌগোলিক ইতিহাসের নিরিখে উত্তর খুঁজেছেন সৈকত আমীন
১৯৪৭ সালের আগস্টে ব্রিটিশ রাজ থেকে বেরিয়ে সিরিল রেডক্লিফের আঁকা রেখা অনুযায়ী ভূখণ্ড ভাগ করে নিয়েছিল ভারত ও পাকিস্তান। দ্বিজাতিত্ত্বের ধারণার বাইরে স্বতন্ত্র থেকে গিয়েছিল হায়দরাবাদ, কাশ্মীরসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চল। পরে হায়দরাবাদকে দখল করে নেয় ভারত। আর অখণ্ড কাশ্মীর এক পর্যায়ে কয়েক খণ্ডে ভাগ হয়ে থেকে যায় ভারত, পাকিস্তান ও চীনের অধীনে।
১৯৪৭ থেকেই ভারত ও পাকিস্তানের ভেতর কাশ্মীর শাসনের অধিকার নিয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বেশ কয়েকবার। ১৯৬৫, ১৯৭১ ও ১৯৯৯ সালে কাশ্মীর ইস্যুতে সামরিক সংঘর্ষেও জড়িয়েছে প্রতিবেশী এই দুই দেশ।
অখণ্ড ভারতীয় ভূখণ্ড কিংবা অখণ্ড কাশ্মীরকে যেভাবে দুই দেশ কাঁটাতারের বেড়াজালে আবদ্ধ করেছে, দেশ দুটির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীর মধ্যে তেমন কাঁটাতার দেওয়ার সুযোগ কারোরই ছিল না। কিংবা সুযোগ থাকলেও ছিল না আন্তর্জাতিক নদী আইন আনুযায়ী তেমন কিছু করার নিয়ম। যেমন কাশ্মীরের নদীগুলোর কথাই ধরা যাক, যার বেশির ভাগ নদীই সিন্ধু নদী-ব্যবস্থার অংশ, উভয় দেশের অর্থনীতি ও জীবনযাত্রার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই নদী-ব্যবস্থা।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের সময় সিন্ধু নদী-ব্যবস্থা একটি একক এবং সংযুক্ত সেচ ব্যবস্থা ছিল। বিভাজনের পর এই নদীগুলো ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। যার মধ্য দিয়ে সূচনা হয় পানি বণ্টন নিয়ে বিবাদের।
কাশ্মীর শুধু একটি ভূখণ্ড নয়; এটি সিন্ধু নদী ব্যবস্থার উৎস। কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ ভারতকে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেয়, যা পাকিস্তানের জন্য একটি কৌশলগত হুমকি।
সিন্ধু পানি চুক্তি (১৯৬০)
পানি বণ্টন নিয়ে উত্তেজনা মেটাতে ১৯৬০ সালে বিশ্ব ব্যাংকের মধ্যস্থতায় দুই দেশের মধ্যে সিন্ধু পানি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির মূল বিষয়গুলো ছিল: সিন্ধু নদী-ব্যবস্থার পূর্ব দিকের নদীগুলো, যেমন রাভি, বিয়াস, সুতলেজ প্রভৃতি নদীগুলোর মোট প্রবাহের ৪১ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি থাকবে ভারতের নিয়ন্ত্রণে। আর পশ্চিমের নদীগুলো, যেমন সিন্ধু, ঝেলম, চেনাব নদীগুলোর মোট প্রবাহের ৯৯ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি থাকবে পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে। পাকিস্তানের ৮০ শতাংশ কৃষি জমির সেচের নির্ভরতা মূলত সেই পশ্চিমের নদীগুলোর ওপরেই।
তবে চুক্তি অনুযায়ী ভারতেরও অধিকার ছিল পশ্চিমের নদীগুলো থেকে সেচ ব্যবহার করার।
এই চুক্তি দীর্ঘদিন ধরে দুই দেশের মধ্যে পানি বণ্টন নিয়ে শান্তি বজায় রেখেছিল। তবে সম্প্রতি ভারতের বাঁধ নির্মাণ এবং চুক্তি স্থগিতের হুমকি এই শান্তিকে বিঘ্নিত করেছে।

পানি কি কৌশলী অস্ত্র?
আগেই ভারত সিন্ধু নদী ব্যবস্থার পশ্চিমের নদীগুলোতে বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করছে, যা সরাসরি সিন্ধু পানি চুক্তির লঙ্ঘন। যেমন, কিষাণগঙ্গা ও রাতলে প্রকল্পের মতো বাঁধগুলো পাকিস্তানে পানির প্রবাহ কমিয়ে দিয়েছে। এছাড়া ভারত পানির তথ্য সরবরাহ এবং বন্যার পূর্বাভাস দেওয়া বন্ধ করায় পাকিস্তানের পানি ব্যবস্থাপনাও পড়েছে জটিলতার ভেতর।
সবশেষ চলতি বছরের ২৪ এপ্রিল ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করার ঘোষণা দেয়। পাকিস্তানে হামলা করার আগেরদিন ৬ মে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘ভারতের পানি ভারতের উন্নয়নের জন্য ব্যবহৃত হবে’।
জেনে রাখা ভালো, পাকিস্তানের অর্থনীতি সিন্ধু নদী ব্যবস্থার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। পাকিস্তানের ৮০ শতাংশ কৃষি জমি (১.৬ কোটি হেক্টর) এই নদীগুলো থেকে সেচ পায়। তাই পানি বন্ধ হলে ফসল উৎপাদন হ্রাস পাবে, যা খাদ্য সংকট সৃষ্টি করতে পারে। কৃষি পাকিস্তানের জিডিপির ২২.৯ শতাংশ এবং রপ্তানির ২৪.৪ শতাংশ এর উৎস। পাকিস্তানের ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ জলবিদ্যুৎ থেকে আসে, যা পানি প্রবাহ কমে গেলে ব্যাহত হবে।
এছাড়া পাকিস্তানের প্রায় ২৫ কোটি মানুষের বেশিরভাগই সিন্ধু নদী ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। ফলে পানি সরবরাহ বন্ধ হলে দেশটিতে দেখা দিতে পারে সুপেয় পানির সংকট। শহর ও গ্রামে জলাভাব মানবিক সমস্যা সৃষ্টি করবে।
বরাবরই কাশ্মীরের পানি নিয়ন্ত্রণ ভারতকে এই অঞ্চলে তার রাজনৈতিক প্রভাব বজায় রাখতে সাহায্য করে। কাশ্মীরের পানি সংস্থান, যেমন হ্রদ ও হিমবাহ, ভারতের বৃদ্ধিমান জনসংখ্যার জন্য পানি সরবরাহের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তন ও পানি সংকটের মধ্যে এই পানি নিয়ন্ত্রণ ভারতের পানি নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করে।
পানি দিয়ে ভারত করবে কী?
ভারত কাশ্মীরের পানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কৌশলগত, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং পানি নিরাপত্তার দিক থেকে বিভিন্ন সুবিধা লাভ করছে। এই সুবিধা শুধু পাকিস্তানকে বধ করার ক্ষেত্রে নয়, এই নিয়ন্ত্রণ নিজ দেশের শুষ্ক অঞ্চলকেও সতেজ রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতেও দারুণ সহায়ক।
ভারতের শুষ্ক অঞ্চল যেমন রাজস্থান, গুজরাত ও মহারাষ্ট্রের কিছু অংশ পানির অভাবে ভুগছে। সিন্ধু নদী-ব্যবস্থা পানির একটি বড় সংস্থান। ২০২৫ সালে সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত হওয়ার পর ভারত এই পানি নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছে। বিজেপির নেতাদের হুঙ্কার, সরস্বতী নদীর পুনরুজ্জীবনের মতো পরিকল্পনা এই আশঙ্কাকে সমর্থন করে।
ভারতের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের শুষ্ক অঞ্চলগুলোতে কৃষি আর জীবনযাত্রার জন্য পানির চাহিদা বেশি। সেখানে সমাধান হিসেবে কাশ্মীর দিয়ে প্রবাহিত সিন্ধু নদী-ব্যবস্থা একটি বড় পানি সংস্থান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
কাশ্মীরের পানি কোনদিকে গড়াবে?
ভারতের জলশক্তিমন্ত্রী সিআর পাটেল ঘোষণা করেছেন, ভারত সিন্ধু নদী-ব্যবস্থার পানি পাকিস্তানে প্রবাহিত হওয়া বন্ধ করবে। এই পানি ভারতের নিজস্ব প্রয়োজনে ব্যবহার করা হবে, যা রাজস্থানের মতো শুষ্ক অঞ্চলগুলোকে উপকৃত করবে। ইতিমধ্যে ভারতের সরকার সংক্ষিপ্ত, মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা তৈরি করেছে। যার মধ্যে মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হিসেবে রয়েছে নতুন জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং পানি বন্টনের নতুন ব্যবস্থা গড়ে তোলা। অন্যদিকে রাজস্থান ও হরিয়ানায় সিন্ধু নদী-ব্যবস্থা ব্যবহার করে সরস্বতী নদী পুনরুজ্জীবিত করা। এই প্রকল্পে সিন্ধু, রাভি, বিয়াস ও সুতলেজ নদীর পানি রাজস্থান আর হরিয়ানায় পৌঁছানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
ভারত ইতিমধ্যেই সিন্ধু নদী ব্যবস্থার পানি ব্যবহার করে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু করেছে। যা রাজস্থানের মতো অঞ্চলগুলোকে বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ করতে পারে। নতুন বাঁধ এবং সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে পানি বন্টনের ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী হবে, যা রাজস্থানের কৃষি এবং জীবনযাত্রাকে উন্নত করবে।
ভারত-পাকিস্তানের যে যুদ্ধ চলছে, সেই যুদ্ধে বন্দুকের গুলি কিংবা মিসাইলের আঘাত হয়তো খুব বেশি মানুষের প্রাণহানির কারণ হবে না। কিন্তু এই যুদ্ধের অজুহাতে যখন ভারত কাশ্মীর থেকে প্রবাহিত নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার অধিকার কেড়ে নেবে, সেটা হবে ২৫ কোটি মানুষের কাছে থেকে তাঁদের জীবন কেড়ে নেওয়ার শামিল। শেষ অব্দি পানির আরেক নাম যেহেতু জীবন।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment