×

সংঘাত থেকে নিষেধাজ্ঞা: রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের অজানা গল্প

গতকাল (১০ মে) গণহত্যার দায়ে দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, জুলাই গণহত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত দলটি তাদের কোন ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। বাংলাদেশের ইতিহাসে দল নিষিদ্ধের এই বিষয়টি অতীতেও ঘটেছে। বিস্তারিত জানাচ্ছেন মো. ইসতিয়াক

গত বছরের জুলাইয়ে স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানলে রুপ নিয়েছিল বাংলার রাজপথ। বাংলাদেশ সাক্ষী হলো এমন এক অভ্যুত্থানের, যার অভিঘাতে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পাল্টে গেল চোখের পলকেই। এক বছর আগেও যেই দল ছিল সবচেয়ে প্রভাবশালী, আজ সেই আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ।

বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নিয়েছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। 

আওয়ামীলীগ নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তে একদিকে চলছে আন্দোলনকারীদের উচ্ছ্বাস। অন্যদিকে জনমনে প্রশ্ন,কোন আইনে একটি কলমের খোঁচাতেই একটি রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা যায়? কে সেই ক্ষমতার অধিকারী? এবং বাংলাদেশের অতীত ইতিহাসে এমন কোনো ঘটনা ঘটেছিল কি না?

বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার জন্য কয়েকটি প্রধান ভিত্তি রয়েছে। প্রতিটি আইনের মূল বক্তব্য সেগুলোর ব্যাখ্যা নিচে তুলে ধরা হলো:

সংবিধান, ১৯৭২

বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘প্রত্যেক নাগরিকের শান্তিপূর্ণভাবে অস্ত্রবিহীনভাবে সমবেত হওয়ার এবং সংগঠন বা সংঘ বা সমিতি গঠনের অধিকার থাকবে, তবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা বা নৈতিকতার স্বার্থে এই অধিকারে আইন দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধ থাকতে পারবে।

এর অর্থ, সংগঠন গঠনের অধিকার মৌলিক হলেও তা অবারিত নয়। যদি কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা বা নৈতিকতার পরিপন্থী হয়, তাহলে এই অনুচ্ছেদের অধীনে আইন দ্বারা দলটির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা কিংবা দলটিকে নিষিদ্ধ করা বৈধ হবে। তবে সংবিধানের ব্যতিক্রমী গুরুত্বের কারণে, এই ব্যবস্থা অত্যন্ত সীমিত বিশেষ পরিস্থিতিতে গ্রহণযোগ্য হয়।

রাজনৈতিক দল (নিবন্ধন পরিচালনা) আইন, ২০২০

এই আইনে বলা হয়েছে, যদি কোনো রাজনৈতিক দলরাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়, সন্ত্রাসবাদে সহায়তা করে, সামরিক বাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে যুক্ত হয়, তবে নির্বাচন কমিশন তাদের নিবন্ধন বাতিল করতে পারে। 

নিবন্ধন বাতিলের মাধ্যমে দলটির নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার চলে যায়। এছাড়া, সরকারের পৃথক প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমেও দলটির রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা সম্ভব।

বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪

এই আইনের () ধারায় বলা হয়েছে, সরকার যদি সন্তুষ্ট হয় যে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা বা জননিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক, তবে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। এই আইন ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনের বিরুদ্ধেও প্রয়োগ করা যায় এবং প্রয়োজনে দল নিষিদ্ধ করার বৈধতা দেয়। তবে এটি একটি ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত হয়।

সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯

এই আইনের ২০ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো সংগঠন সন্ত্রাসী কার্যক্রমে যুক্ত থাকে, সন্ত্রাসবাদে সহায়তা করে বা তার প্রচারণা চালায়, তাহলে সরকার ওই সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে।

সরকার সাধারণত দুটি ধাপে দল নিষিদ্ধ করে। প্রথমত, প্রশাসনিক আদেশের মাধ্যমেযেখানে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে দলের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়। 

দ্বিতীয়ত, বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেযেখানে হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টের আদেশে দলকে অবৈধ ঘোষণার জন্য আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। যদি কোনো দল সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে আবেদন করে, তখন চূড়ান্ত বৈধতা নির্ধারিত হয় আদালতের আদেশের মাধ্যমে।

ইতিহাস কী বলে

রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধকরণের এই ধারার উৎপত্তি ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনকাল থেকে। ব্রিটিশ সরকার ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করার জন্য নানান সময় তৈরি করে গেছে কিছু আইন। যেমন: বেঙ্গল স্টেট প্রিজিডেন্টস অ্যাক্ট (১৮১৮), রোলাট অ্যাক্ট (১৯১৯), ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট (১৯৩৯)

এসব আইনের মাধ্যমে ব্রিটিশরা রাজনৈতিক সংগঠন ব্যক্তিদেররাষ্ট্রবিরোধীহিসেবে চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার, সংগঠন নিষিদ্ধ নজরদারির ব্যবস্থা চালু করে। তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই আইনের প্রয়োগ দেখা যেত কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকর্মীদের ওপর দমনপীড়ন চালাতে।

ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া আইনগুলোর ব্যবহার অব্যাহত ছিল পাকিস্তান আমলেও। এছাড়া পাকিস্তান সরকার নতুন করে পাবলিক অর্ডার অ্যাক্ট, ১৯৪৯ এবং ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুলস চালু করে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা হুমকি ঠেকাতে এই আইনের মাধ্যমে সরকার কোনো দল বা সংগঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারত। এর ধারাবাহিকতায়: কমিউনিস্ট পার্টি, খুদাই খিদমতগার আন্দোলন, এবং পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগসহ আরও কয়েকটি সংগঠনের কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করা হয়। 

১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারি হলে সরাসরি সব রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম স্থগিত করে দেওয়া হয়১৯৬০- এর দশকে  রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তনের সময় নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলগুলো আবার কার্যকর রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।

স্বাধীনতার পর কি হয়েছে

ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলের ধারাবাহিকতায়  রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধকরণের চর্চা বাংলাদেশেও চলে আসছে  

১৯৭৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের প্রশাসন দেশে জরুরি অবস্থা জারির উদ্দেশ্যে বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রণীত করে, যা মূলত পাকিস্তান আমলের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা আইনের আদলে তৈরি। 

পরে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯ রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইন ২০২০প্রণয়ের এর মাধ্যমে দল নিষিদ্ধ করার আইনি কাঠামো আরও সুসংহত করে।

এ ছাড়া ১৯৭৫ সালে বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাষ্ট্রের সাথে রাজনৈতিক দলকে একীভূত করার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ ও দলটির তৎকালীন মিত্র বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি নিজেদের বিলুপ্ত ঘোষণা করেছিল। বাকশালের একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় নিষিদ্ধ করা হয়েছিল সকল দলের রাজনৈতিক কার্যক্রম। 

দল নিষিদ্ধের নজির কম

বাংলাদেশের ইতিহাসে মূল ধারার রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার নজির কম। তবে ২০১৩ সালে জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বাতিল করেছিল আদালত। এ ছাড়া চরমপন্থী সংগঠন হিসেবে বিবেচিত সর্বহারা পার্টি বা পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধকরণের নজির রয়েছে। মূলধারার রাজনীতিতে কোনো দলকে পুরোপুরি নিষিদ্ধকরণ বিরল হলেও ২০২৪ সালের ১লা আগস্ট, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাহী আদেশের মধ্য দিয়ে জামায়াতে ইসলামীর কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

এই নিষেধাজ্ঞা মূলত ২০১১ ও ২০১২ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলার রায় এবং অন্যান্য দলিলের আলোকে জারি করা হয়। তবে জুলাই অভুথ্যানের পর গঠিত অন্তবর্তীকালীন সরকার ওই নির্বাহী আদেশ প্রত্যাহার করে নেয়।

আদেশ কী স্থায়ী হয়?

আইনগতভাবে দল নিষিদ্ধকরণ আদেশ স্থায়ী হতে পারে, তবে এটি আদালতের পুনর্বিবেচনার অধীন থাকে। যদি পরে দেখা যায় যে নিষিদ্ধকরণের যুক্তি টেকসই নয়, অথবা যদি রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তনে সরকার নিজেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে চায়, তাহলে সেই নিষেধাজ্ঞা বাতিল হতে পারে।

রাজনৈতিক বাক বদলের সময় কোনো দলের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা বাতিলও হতে পারে। সাধারণত এই প্রক্রিয়া সংগঠিত হয় মূলত দুইটি মাধ্যমে। প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত কিংবা বিচারিক আদেশে।

প্রশাসনিকভাবে, সরকার চাইলে নতুন করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে পূর্বের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে পারে, বিশেষ করে যদি তারা মনে করে পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়েছে বা নিষেধাজ্ঞার প্রয়োজনীয়তা আর নেই অন্যদিকে, দল নিজেই আদালতের দ্বারস্থ হয়ে নিষেধাজ্ঞা বাতিলের আবেদন করতে পারে। আদালত যদি মনে করে যে নিষেধাজ্ঞা প্রদান আইনসঙ্গত ছিল না অথবা পরবর্তীকালে পরিস্থিতির গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে, তবে আদালত নিজ ক্ষমতাবলে নিষেধাজ্ঞা বাতিল করতে পারে। 

এই গোটা প্রক্রিয়ায় আইনি ভিত্তি হিসেবে মূলত সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ এবং প্রশাসনিক আইনের নীতিসমূহ প্রয়োগ করা হয়, যেখানে সংগঠিত হওয়ার অধিকার এবং প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা বিচার করা হয়।

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment