মিম কি ভারত-পাকিস্তানের তরুণদের যোগাযোগের নতুন ভাষা হয়ে উঠছে
যুদ্ধ এখন আর কেবল সীমান্তে গোলাবর্ষণ নয়, তা চলছে টেলিভিশনের পর্দায় বা স্মার্টফোনের স্ক্রিনে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ভারতে যখন সংবাদমাধ্যমে পাকিস্তানবিরোধী যুদ্ধ-উন্মাদনা তুঙ্গে, তখন ফেসবুকের ‘ইন্দো/পাকু ওয়ারপোস্টিং’ নামের মিমপেজে ভারত-পাকিস্তানের তরুণরা একসঙ্গে হাসছেন একই রকম ট্রোলে। কী ঘটছে সেখানে? মিমগুলো কি বিকল্প গণমাধ্যমের উৎস হয়ে উঠছে? লিখেছেন রাতুল আল আহমেদ
: ‘ভারত যদি সত্যিই পাকিস্তান আক্রমণ করে, তবে পাকিস্তান আর্মি কীভাবে ঠেকাবে?’
: ‘কেন, সীমান্তে গরুর প্রাচীর তৈরি করে!’
অথবা,
: ‘সিন্ধুর পানি বন্ধ করার আগে ভারতীয় বন্ধুরা কি তাঁদের মায়ের কথা (গরুকে দেখিয়ে) ভুলে গেল, যাকে আমরা পালন করছি?’
এগুলো ‘ইন্দো\পাকু ওয়ারপোস্টিং’ নামের ফেসবুক গ্রুপের জনপ্রিয় মিমগুলোর কয়েকটি উদাহরণ। মজার ব্যাপার হলো, এসব মিম পাকিস্তানিরা বানালেও ভারতীয়রাই অধিকাংশ সময় হাহা রিঅ্যাকশনে সাড়া দিচ্ছেন।
যুদ্ধের মতো গুরুতর বিষয়কে এমনভাবে ঠাট্টায় পরিণত করা—এই ট্রেন্ড যেন দুই দেশের তরুণদের মধ্যে এক ধরনের অলিখিত শান্তিচুক্তির সূচনা। যদিও টিভির স্ক্রিনে সেই হাসির ছায়া খুঁজে পাওয়া ভার। সেখানে হিংসা, প্রতিহিংসা আর রণহুঙ্কারেই ভরে থাকে পর্দা।
গণমাধ্যম কি আগুনে ঘি ঢালছে?
১০ মে মার্কিন মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছায়। ভারতীয় মূলধারার গণমাধ্যম সেই সিদ্ধান্তকে কতটা গুরুত্ব দিলো?
‘রিপাবলিক টিভি’, ‘আজ তাক’-এর মতো কিছু চ্যানেলের উপস্থাপকেরা যেন যুদ্ধের চেয়ে নাটকীয়তা বেশি বিক্রি করেছেন। চিৎকার, রণ সংগীত, গ্রাফিক ভিজ্যুয়াল—সব মিলিয়ে এক উত্তেজক পরিবেশ তৈরি করে চলছে ‘দেশপ্রেমের উত্তেজনা’। এমনকি তাঁরা পাকিস্তানকে হামলার উসকানি দিতেও পিছপা হচ্ছেন না, যেন ভারত পালটা আক্রমণ করে ‘জয় উপভোগ’ করতে পারে।
একটি ভয়াবহ ও প্রাণঘাতী ঘটনা কীভাবে ‘উপভোগ্য’ হয়ে ওঠে এই প্রশ্ন একান্তভাবে ভাববার দাবি রাখে।
সত্যের বিকৃতি
এই গণমাধ্যম প্রচারণার আরেকটি দিক হলো ‘শত্রু রাষ্ট্র’কে দানবে পরিণত করা। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভুয়া ভিডিও, ছবি ও তথ্য ব্যবহার করে ঘৃণার আবহ তৈরির অভিযোগ উঠেছে ফ্যাক্টচেকারদের পক্ষ থেকে।
ফ্যাক্টচেকারদের ভাষায় সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল সত্যের খোঁজ করা। কোথাও ভিডিও গেমের গ্রাফিক্সকে হামলা বলে চালানো হয়েছে। আবার কোথাও ভিন্ন ঘটনার ছবি ভারতের ওপর হামলা বলে প্রচারিত হয়েছে। ‘জাতীয়তাবাদ’-এর নামে অনেক সময় একপাক্ষিক রিপোর্ট করে সন্দেহ তৈরি করা হয়েছে ভারতীয় মুসলমানদের দেশপ্রেম নিয়েও। সেক্যুলারদের দেশছাড়া করার হুমকিও উঠে এসেছে চ্যানেলের বিতর্কে।
ভিন্ন কণ্ঠ এবং তার প্রতিক্রিয়া
যে সশস্ত্র হামলা নিয়ে উত্তেজনার সূত্রপাত, সেই পেহেলগামের হামলায় নিহত হন ভারতীয় নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট বিনয় নারওয়াল। তাঁর স্ত্রী হিমাংশির মৃত স্বামীর পাশে নিঃশব্দ শোকের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে তা অনেককে নাড়া দেয়।
এই আবহে যখন ভারতের মুসলিম ও কাশ্মীরিদের ওপর হামলার খবর আসতে থাকে, তখন হিমাংশি সামনে এসে বলেন এটা ন্যায়বিচারের পথ নয়।
তাঁর এই বক্তব্য প্রশংসিত হওয়ার বদলে কিছু চরমপন্থীদের ট্রোলের শিকার হয়। তাঁকে ‘অপয়া’ কিংবা ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দিয়ে ব্যক্তিগত আক্রমণ চালানো হয়। এই প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট করে দেয় সবাই ন্যায়ের পাশে দাঁড়ায় না; অনেকের কাছেই হিংসা একটি অস্ত্র।
যুদ্ধবাজির রাজনৈতিক ফায়দা
কলকাতার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রাক্তন ছাত্র সৃঞ্জয় দেবগুপ্ত মনে করেন, ‘যুদ্ধবাজরা সবসময় যুদ্ধ চায়। কারণ যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি থেকেই তাদের লাভ হয়। প্যালেস্টাইন কিংবা ইউক্রেনের মতো এখানেও এক পক্ষ যুদ্ধ বিক্রি করতে চায়।’
তাঁর মতে, এই উত্তেজনা তৈরি করে বিজেপি সরকার তাদের ভোটব্যাংক আরও সংহত করার চেষ্টা করছে। আর গণমাধ্যম সেই প্রপাগান্ডার হাতিয়ার।
জৈবরাজনীতি ও যুদ্ধের বয়ান
এই বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করা যায় ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর বায়োপলিটিক্স বা জৈবরাজনীতির আলোকে। ফুকো বলেছিলেন, আধুনিক রাষ্ট্র মানুষকে শুধু শাস্তি দেয় না, তার মানসিক কাঠামোও গড়ে তোলে।
যখন টিভিতে বারবার যুদ্ধ দেখানো হয়, তখন মানুষ তাতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। কী নিয়ে তারা ভীত হবে বা উল্লসিত হবে তা নির্ধারণ করে রাষ্ট্র ও গণমাধ্যমের সম্মিলিত প্রচারণা। ফুকোর মতে, ক্ষমতা জ্ঞানেরও নির্মাতা। সেই জ্ঞান নিরপেক্ষ নয়।
তরুণদের বিকল্প বয়ান: যুদ্ধের বিরুদ্ধে হাস্যরস
তবে এই প্রচারণায় পুরো ভারতই যে ডুবে গেছে, তা নয়। তরুণ সমাজের একটা বড় অংশ যুদ্ধবাজ গণমাধ্যমর এই বয়ানকে চ্যালেঞ্জ করছে। তাঁরা মিম, ঠাট্টা আর ব্যঙ্গের মাধ্যমে যুদ্ধকে অস্বীকার করছে। বিপরীতে যুদ্ধবিরোধী এক ‘জনবয়ান’ তৈরি করছে যা গণমাধ্যমের বিকল্প।
এই তরুণেরা সোশ্যাল মিডিয়ায় এক ধরণের বন্ধন তৈরি করছেন, যেখানে ভারত-পাকিস্তান দুটি দেশ শত্রু নয়। বরং তাঁরা একই ধরণের দমন ব্যবস্থার শিকার, এই উপলব্ধিই প্রকাশ পাচ্ছে।
ভারতে কট্টরপন্থী বিজেপি ও আরএসএস সোশ্যাল মিডিয়ায় মিথ্যা ও ভুয়া সংবাদ ছড়িয়ে ভারতে সংবাদের বিশ্বস্ততা ইতিমধ্যেই ধ্বংস করে ফেলেছে। ‘হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি’ নামে একটি প্রত্যয় তৈরি হয়েছে এসব কল্পিত ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে। ফলে প্রশ্ন উঠছে, সাধারণ জনগণ তাহলে সংবাদের জন্য কীসের ওপর নির্ভর করবে?
এই প্রসঙ্গে কথা হয় কলকাতার সেন্ট পলস ক্যাথেড্রাল মিশন কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক অনামিত্রা সরকারের সঙ্গে। তিনি বিকল্প গণমাধ্যম গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘সাধারণ মানুষ কিন্তু যুদ্ধ ভয় পায়। বর্তমানে মূলধারার পত্রিকা বা টেলিভিশনে যুদ্ধকে যেভাবে মুখরোচক করে তুলছে তাতে মানুষের মধ্যে যুদ্ধকে স্বাভাবিক করে তোলার একটা চেষ্টা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। আমরা যারা ১৯৬৫ বা ১৯৭১ সালের যুদ্ধ দেখেছি, তাঁরা এর ভয়াবহতার সাক্ষী।’
এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে তিনি জোর দেন মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের। তাঁর মতে পারস্পরিক যোগাযোগই পারে নিজেদের প্রতি ভয় কাটিয়ে একসঙ্গে যুদ্ধকে মোকাবিলা করতে।
সোশ্যাল মিডিয়া: স্বাধীন মত প্রকাশ না কি নতুন বিভাজনের ক্ষেত্র?
সোশ্যাল মিডিয়া অনেকের জন্য মুক্ত মত প্রকাশের জায়গা, আবার কখনো তা বিভ্রান্তি ও ট্রোলের উৎস। কিন্তু এখানেই বিকল্প স্বর সবচেয়ে জোরালোভাবে প্রকাশ পায়। ফলে মিমের মতো হাস্যরসাত্মক উপাদানের মধ্য দিয়েও শান্তির বার্তা খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
বর্তমান সময়ে যুদ্ধ মূলত যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, বরং যুদ্ধ চলে জনগণের মনস্তত্বে। যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করে রাষ্ট্র ও সরকার যেখানে জনগণের মনস্তত্ত্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, সেখানে মিম-সংস্কৃতি তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। জনগণের সত্যিকারের কণ্ঠ কোনটা, যুদ্ধপ্রিয় টক শো, না কি হাস্যরসে মোড়া শান্তির আহ্বান?
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment