মৃত্যুতে সংবাদে কেন ‘হাহা’ রিয়্যাকশন
২০২০ সালের ২৪ অক্টোবর, মাত্র ১৪ বয়সে বিয়ে পিঁড়িতে বসতে বাধ্য করা হয় নুর নাহারকে। বিয়ের রাতে স্বামী শারীরিক সম্পর্ক করতে গেলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে অজ্ঞান হয়ে পড়ে নাহার। অবস্থা গুরুতর দেখে টাঙ্গাইল থেকে তাকে আনা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় নাহার। যেকোনো বিচারেই ঘটনাটা মর্মান্তিক। বাল্য বিবাহ থেকে মৃত্যু- পুরোটাই। তবে সব মর্মান্তিকতা ছাপিয়ে যায় সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর মৃত্যুর খবরে কয়েক হাজার ‘হাহা’ রিয়্যাক্ট। এর আগে-পরেও বিভিন্ন সময়ে মর্মান্তিক সংবাদে গণহারে ‘হাহা’ দেওয়ার ঘটনাও নজরে এসেছে বিবেকবান মানুষের। কিন্তু কেন এরকম ঘটে? লিখেছেন শতাব্দীকা ঊর্মি
সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রায়ই দেখা যায় মানুষের মৃত্যুর সংবাদে পড়ছে অসংখ্য ‘হাহা’ রিয়্যাকশন। এ এক অদ্ভুত ও বেদনাদায়ক সামাজিক বাস্তবতা। যাঁরা এর পেছনে রয়েছে গভীর সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং প্রযুক্তিগত কিছু প্রক্রিয়া।
অনেক ব্যবহারকারী এখনো সোশ্যাল মিডিয়ার ইমোজি রিয়্যাকশনগুলোর অর্থ সঠিকভাবে বোঝেন না। তারা “হাহা” রিয়্যাকশনকে হয়তো “মনোযোগ আকর্ষণ” বা “রিয়্যাকশন দেওয়ার মাধ্যম” হিসেবে দেখে থাকেন, অর্থের দিকে না তাকিয়ে।
দার্শনিক মার্শাল ম্যাকলুহান তাঁর আন্ডারস্ট্যান্ডিং মিডিয়া বইয়ে বলেন, কোনো বার্তা যে মাধ্যমে প্রেরণ করা হয়, সেই মাধ্যমটি নিজেই বার্তার চেয়েও অধিক প্রভাবশালী ও অর্থবহ। অর্থাৎ, বার্তায় কী বলা হচ্ছে, তা নয়, বরং যেভাবে বা যে প্রযুক্তিতে বলা হচ্ছে, সেটাই সমাজে বেশি প্রভাব রাখে।
উদাহরণস্বরূপ, সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের যোগাযোগের ধরণ এতোটাই পাল্টে দিয়েছে যে— মৃত্যু কিংবা বেদনার মতো অনুভূতিও সেখানে নির্দিষ্ট ইমোজি বা রিয়্যাকশন বাটনে সীমাবদ্ধ গেছে।
সাইবারসাইকোলজিস্ট জন সুলারের ‘ইন সাইবার-সাইকোলজি অন বিহেভিয়ার’ বইয়ের ‘ডিজিটাল ডিসইনহিবিশন ইফেক্ট’ প্রবন্ধের ধারণা অনুযায়ী, অনলাইনে মানুষের নিজের সত্তাকে মেলে ধরার তাড়না বেশি থাকে। অনুসারীদের কাছে আগ্রহ ধরে রাখতে সেই তাড়না কখনো কখনো পৌঁছায় নিষ্ঠুর পর্যায়ে।
অনলাইনে মানুষ বাস্তব জীবনের সামাজিক মূল্যবোধ কম অনুভব করে। ফলে অনেক সময় তারা এমন প্রতিক্রিয়া জানায় যা বাস্তবজীবনে কখনো প্রকাশ করত না।
সামাজিক অসংবেদনশীলতা ও সহানুভূতির সংকট
বর্তমান সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে মানুষের মধ্যে সহানুভূতির অভাব দেখা দিচ্ছে। কেউ কেউ মৃত্যুকে নিছক একটি “ইভেন্ট” হিসেবে দেখে, বাস্তব বেদনার চেয়ে “কনটেন্ট” হিসেবে বেশি দেখে।
এ প্রসঙ্গে নৃবিজ্ঞানী মির্জা তাসলিমা সুলতানা বলেন , ‘ফেসবুকে রিয়াকশন গুলো তৈরি হয়েছিল ইন্ডিভিজুয়াল হিসেবে। যেহেতু পশ্চিমা ধারণা ইন্ডিভিজুয়ালিটিকে গুরুত্ব দেয়, তাই এই ব্যবস্থা। কিন্তু বাংলাদেশে এটাকে পলিটিক্যাল চোখ দিয়ে দেখতে হবে। ব্যাপারটা কালেক্টিভ সেন্স থেকে ঘটে। বাংলাদেশে মৃত্যুর ঘটনায় হাহা দেওয়া এক ধরনের পলিটিক্যাল এক্টিভিজম। মূলত ভিন্ন আদর্শের কাউকে ভিলেনাইজড করে, তার মৃত্যুতেও যাতে সহানূভূতি না প্রতিষ্ঠা পায় সেজন্য এগুলো করা হয়।’
ফরাসি তাত্ত্বিক গাই দেবোর্ড এর “দ্য সোসাইটি অফ স্পেক্টাকলস” বইয়ে দেখানো হয়েছে, আধুনিক সমাজে সবকিছু এক ধরণের ভিজ্যুয়াল স্পেকটাকল বা প্রদর্শন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মৃত্যু, দুঃখ, আনন্দ—সবই যেন কন্টেন্ট হয়ে গেছে। স্পেক্টাকলস বলতে বোঝানো হচ্ছে, এমন এক সমাজ যেখানে বেঁচে থাকাটা যেন এক দেখানোর বিষয়।
ট্রোলিং প্রবণতা
কিছু সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী ইচ্ছাকৃতভাবে ‘হাহা’ রিয়্যাকশন দেন ট্রোলিং বা বিদ্রুপ করার মানসিকতা থেকে। এটা অনেকটা ‘শক ভ্যালু’ বা সমাজকে আঘাত করে আনন্দ পাওয়ার প্রবণতা।
‘দ্য সাবলাইম অবজেক্ট অব ইডিওলজি’ বইয়ে দার্শনিক স্লাভোয় জিজেক দেখিয়েছেন, আধুনিক সমাজে অর্থের উল্টাপাল্টা ব্যবহার (reversal of meaning) বেড়ে গেছে। হাসির ইমোজি এখন আর শুধু আনন্দ প্রকাশ করে না, বরং তাচ্ছিল্য, উপহাস, এমনকি ঘৃণার প্রতীকও হয়ে উঠেছে।
অ্যালগরিদমিক দায়বদ্ধতা ও সীমাবদ্ধতা
সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যালগরিদম মূলত ইন্টারঅ্যাকশনের উপর কাজ করে। কে কী রিয়্যাকশন দিল, সেটা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার হয় না। ফলে এই ভুল প্রতিক্রিয়াগুলো আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ে।
মৃত্যুর মত গভীর ও বেদনাদায়ক বিষয়ের নিচে ‘হাহা’ রিয়াকশন পড়া শুধুই ব্যক্তি বিশেষের সমস্যা নয়। এর পেছনে রয়েছে প্রযুক্তিগত অজ্ঞতা, সামাজিক অনুভূতির অবক্ষয়, ডিজিটাল সংস্কৃতির বিচ্যুতি এবং অ্যালগরিদমিক কাঠামোর সীমাবদ্ধতা।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment