কেন আটকে আছে ইশরাকের শপথ: আইনি জটিলতা নাকি রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব
মো. ইসতিয়াক
উচ্চ আদালতের রায়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নতুন মেয়র হিসেবে জয়ী ঘোষণা করা হয়েছে বিএনপি নেতা প্রকৌশলী ইশরাক হোসেনকে। এ-সংক্রান্ত গেজেটও প্রকাশিত হয়েছে। অথচ আজ পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেননি। এই দীর্ঘ অপেক্ষার মধ্যে নগর ভবনের সামনে ছয় দিন ধরে চলছে বিক্ষোভ। ‘ঢাকাবাসী’ ব্যানারে শুরু হওয়া এই আন্দোলন তুলে ধরেছে রাজধানীর প্রশাসনিক কাঠামোর জটিলতার চিত্র—আইন, রাজনীতি ও প্রশাসনের সংযোগে তৈরি হওয়া সংকটের মুখোমুখি রাজধানী।
আদালতের রায় ও গেজেট
২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শেখ ফজলে নূর তাপসকে বিজয়ী ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। তবে পরাজিত বিএনপি প্রার্থী ইশরাক হোসেন ভোট কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন।
দীর্ঘদিনের বিচার প্রক্রিয়ার পর, চলতি বছরের ২৭ মার্চ আদালত ইশরাকের পক্ষে রায় দেন এবং আগের ফলাফল বাতিল করে তাঁকে বৈধ মেয়র ঘোষণা করেন। এরপর ২৭ এপ্রিল নির্বাচন কমিশন গেজেট প্রকাশ করে, যা রাজনৈতিক মহল ও ইশরাকের সমর্থকদের মধ্যে নতুন করে আশা জাগায় যে খুব শিগগিরই তিনি শপথ নেবেন।
আইনি জটিলতা না কি প্রশাসনিক কৌশল
গেজেট প্রকাশের পরপরই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় আইন মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি পাঠিয়ে শপথে আইনি বাধা আছে কি না, তা জানতে চায়। চিঠিতে ‘স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯’-এর ধারা ১২(২), ১৬(২), ও ১৬(৩) উল্লেখ করে বলা হয়—শপথ নেওয়ার পরই মেয়রের কার্যক্রম শুরু হয়, এবং শপথের দিন থেকেই মেয়াদের গণনা শুরু হয়।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমাদের মতামত চাওয়ার আগেই গেজেট প্রকাশিত হয়েছে, তাই আমরা এখন কিছু বলতে পারি না।’ তাঁর এই বক্তব্যের পরই শপথ কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে পড়ে।
রিট ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই রায়
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে আরও বলা হয়, নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের রায়ে নির্বাচন কমিশন কোনো পক্ষ নেয়নি এবং একতরফাভাবে রায় দেওয়া হয়েছে।এমনকি আরজি সংশোধনের বিষয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করেও ট্রাইব্যুনাল রায় দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
একই সঙ্গে হাইকোর্টে দায়ের হওয়া একটি রিটে ট্রাইব্যুনালের রায়কে ‘জালিয়াতিমূলক’ বলে দাবি করা হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট বিচারকের বিরুদ্ধেও শাস্তির দাবি জানানো হয়েছে।
নগর ভবনের রাজপথে আন্দোলন
১৪ মে থেকে নগর ভবনের সামনে আন্দোলনে বসেন ইশরাকের সমর্থকেরা। প্রথম দিনই ‘নগরবাসী’ ব্যানারে মিছিল নিয়ে ভেতরে ঢুকে সিঁড়িতে অবস্থান নেন তাঁরা। পরদিন থেকে পুরান ঢাকা, সূত্রাপুর, বংশালসহ বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে সাধারণ মানুষ ও বিএনপি নেতা-কর্মীরা জড়ো হন। আন্দোলনের ভাষ্য স্পষ্ট—’গেজেট প্রকাশিত, তাহলে শপথে বাধা কোথায়?’
সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব মশিউর রহমান বলেন, ‘আইনি প্রক্রিয়ার সবকিছু সম্পন্ন হলেও একটি অদৃশ্য মহল দায়িত্ব হস্তান্তরে বাধা দিচ্ছে।’ আন্দোলনকারীরা ১৭ মে সচিবালয় অভিমুখে লংমার্চের কর্মসূচিও ঘোষণা করে।
নগর ভবনের কর্মচারীদের একাংশও আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে কর্মবিরতিতে যান, ফলে নগরসেবায় স্থবিরতা সৃষ্টি হয়।
উপদেষ্টা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য
যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সরাসরি মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘আইনি জটিলতা এখনো নিরসন হয়নি, হাইকোর্টে রিট বিচারাধীন।’ ইশরাক হোসেন জবাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, ‘আদালতের রায় ও গেজেট থাকার পরও রাজনৈতিক স্বার্থে শপথ থামিয়ে রাখা হচ্ছে।’
জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহ প্রায় একই সুরে ফেসবুক পোস্টে বলেন, রাজনীতির স্বার্থে সত্যকে দমন করা হচ্ছে। এমন জনপ্রিয় নেতাকে আটকে রাখা গণতন্ত্রের ওপর আঘাত।
আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার সায়িদ রহমান স্ট্রিমকে বলেন, ‘যদি আদালতের রায় এবং গেজেট প্রকাশিত থাকে, তাহলে শপথে বিলম্ব করা আইন ও সংবিধান পরিপন্থী হতে পারে। হাইকোর্টে রিট থাকলেও তাতে স্থগিতাদেশ না থাকলে শপথ নেওয়া থেকে কাউকে বাধা দেওয়ার সুযোগ নেই। বিষয়টি মূলত প্রশাসনিক সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে।’
ব্যারিস্টার সায়িদ আরও যোগ করেন, ‘একতরফা রায় হলেও তা কার্যকর হয় যদি তা চ্যালেঞ্জ না করা হয়—যেমন এখানে দেখা যাচ্ছে।’
ইশরাক হোসেনের মেয়র হিসেবে শপথ গ্রহণ এখন আর শুধু একটি আইনি আনুষ্ঠানিকতা নয়—এটি হয়ে উঠেছে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং আইনের শাসনের একটি বড় পরীক্ষা। আন্দোলনকারীরা বলছেন, জনগণের রায় অগ্রাহ্য করলে রাজপথই শেষ ভরসা। সরকার বলছে, আইনি প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছুই নিশ্চিত নয়।
কিন্তু এর মাঝখানে পড়ে ঢাকার নাগরিক সেবা, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং রাজনৈতিক ভারসাম্য—সবকিছুই এখন প্রশ্নের মুখে।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment