রক্তাক্ত হৃদয়ে কাশ্মীর : ‘বারবার বলেছি আমাদের বাঁচান, কিন্তু কেউ আসেননি’
িকাশ্মীর সীমান্তে ভারত-পাকিস্তানের সামরিক উত্তেজনার রক্তাক্ত ফল ভোগ করছে সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে শিশুরা। গোলাবর্ষণে একের পর এক প্রাণ ঝরেছে, কোল খালি হচ্ছে মায়েদের। এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সীমান্তবর্তী মানুষের অসহায়তা, রাষ্ট্রের ব্যর্থতা ও যুদ্ধের নিষ্ঠুর বাস্তবতা। এ বিষয়ে আল জাজিরার প্রতিবেদন অবলম্বনে লিখেছেন শতাব্দীকা ঊর্মি
একটি গোলাপি টুপি পরা মেয়ের ছবি তুলে ধরে জাভেদ ইকবাল কান্নায় ভেঙে পড়েন। ছবির মেয়েটি তাঁর পাঁচ বছর বয়সী কন্যা মরিয়ম। এখন সে আর নেই। ৭ মে ভোরে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের কাছাকাছি পুঞ্চ জেলার সুখা কাঠা গ্রামে একটি গোলা পড়ে তাদের বাড়িতে। গোলার আঘাতে মৃত্যু হয় ছোট্ট মরিয়মের। আহত হয় তার বোন ইরাম।
এই ঘটনাটি কেবল একটি শিশুর করুণ পরিণতির গল্প নয়। এটি কাশ্মীরের সীমান্তবর্তী মানুষের দীর্ঘস্থায়ী আতঙ্ক, নিরাপত্তাহীনতা এবং যুদ্ধের অমানবিক মূল্য তুলে ধরে।
ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা
ঘটনাটি ঘটেছে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এক চরম সামরিক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে তীব্র সীমান্ত সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ২১ জন বেসামরিক নাগরিক।
মাত্র চার দিনে গোলাবর্ষণ ও ড্রোন হামলায় সীমান্তঘেঁষা এলাকা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে।
ভারত বলেছে, ২২ এপ্রিল পর্যটনকেন্দ্র পাহেলগামে ২৫ জন পর্যটককে হত্যা করে যেসব বন্দুকধারী, তাদের পাকিস্তান মদদ দিয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় ৭ মে ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। পাকিস্তান পাল্টা জবাবে শেল নিক্ষেপ করে।
এই উত্তেজনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সীমান্তের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে শিশুরা।
‘আমি আর এই শোক বইতে পারব না’
৩৬ বছর বয়সী জাভেদ ইকবাল বলেন, ‘আমি বারবার পুলিশকে, প্রশাসনকে, টোল-ফ্রি নাম্বারে ফোন করেছি। বলেছি, আমাদের বাঁচান। কিন্তু কেউ আসেননি।’
তিনি স্ত্রী ও ছয়টি শিশুকে নিয়ে একটি গুদামঘরে লুকান। সেই ঘরের ভারী ছাদও রক্ষা করতে পারেনি মরিয়মকে। শেলের টুকরায় ভোরের আলোয় ঝরে যায় তার প্রাণ।
ইকবাল বলেন, ‘পাঁচবার অ্যাম্বুলেন্স আমাদের বাড়ির কাছে আসার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু প্রতিবার ফিরে যেতে হয়েছে গোলাবর্ষণের কারণে।’
মরিয়ম মারা যায় হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই।
বিস্ফোরণের নীরবতা
সুখা কাঠা গ্রামে আগে প্রায় ২০০টি পরিবার থাকত। এখন বেশিরভাগই এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে। ফাঁকা বাড়িগুলোতে হাওয়ার শব্দ, ধুলা আর ভয়ানক নিস্তব্ধতা।
৩৫ বছর বয়সী স্থানীয় বাসিন্দা মুহাম্মদ মুখার বলেন, ‘আমরা কেবল চোর-ডাকাত ঠেকাতে রয়েছি। গ্রামের মানুষ ফিরবে না। সবাই জানে, এই শান্তি অস্থায়ী।’
কাশ্মীরি বিশ্লেষক জাফর চৌধুরী বলেন, ‘পাকিস্তানের সেনা অবস্থান পাহাড়ে হওয়ায় তাদের গোলা সহজেই ভারতীয় উপত্যকায় পড়ে। কিন্তু ভারতীয় প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানি অঞ্চল ততটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।’
খানেতার শহরে গোলার আঘাতে মারা যায় ১৩ বছরের বিবহান কুমার। পালানোর সময় পরিবারের গাড়িতেই নিহত হয় সে। তার বাবা বলেন, ‘প্রচণ্ড শব্দের পর দেখি ছেলে রক্তে ভাসছে।’
যমজদের মৃত্যু
পুনছ থেকে ২৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে, জম্মুর হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন শিক্ষক রমিজ খান। তার যকৃতের পাশে স্প্লিন্টার ঢুকেছে।
তিনি ও স্ত্রী আরুশা শোক করছেন তাদের যমজ সন্তান জয়েন আলি ও উরবার মৃত্যুতে। তারা গোলাবর্ষণে মারা গেছে।
সেদিন সকালে আতঙ্কে তারা চাচাকে ফোন করে। তিনি পৌঁছালে সবাই গাড়ির দিকে ছুটছিল। তখনই একটি শেল বিস্ফোরণ ঘটে। উরবা সেখানেই মারা যায়। জয়েন কয়েক শ ফুট দূরে গিয়ে নিথর হয়ে পড়ে।
আরুশার বোন মরিয়া পাঠান বলেন, ‘আমরা আমাদের শত্রুদের জন্যও এই যন্ত্রণা চাই না।’
যুদ্ধাপরাধ?
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়ার উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, ‘নির্বিচারে বেসামরিক এলাকায় গোলাবর্ষণ আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের লঙ্ঘন। ইচ্ছাকৃত হলে, তা যুদ্ধাপরাধ।’
এই কথা শুধু কাগজে-কলমে নয়, বাস্তবেও গভীর। কারণ, যুদ্ধে সিপাহী-মেজর নয়, শিশুদের রক্ত ঝরে। মায়েরা সন্তান হারান। গ্রামগুলো ভুতুড়ে ভূগোলে পরিণত হয়।
রাজনৈতিক ব্যর্থতা ও মানবিক বিপর্যয়
কাশ্মীরের বিশ্লেষকরা বলেন, সীমান্ত সংঘর্ষ শুধু প্রতিহিংসা নয়। এটি ভারতের ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক ব্যর্থতার প্রতিফলন। উভয় দেশই জাতীয়তাবাদী অবস্থান দৃঢ় করতে এই সংঘর্ষকে কাজে লাগায়।
সীমান্তবাসীদের জন্য এই লড়াই মানে মৃত্যুর পূর্বাভাস। শিশুদের কাছে ‘গোলার শব্দ’ নতুন দিনের সূচনা নয়, বরং জীবনের অবসান।
একটি ছোট টুপির নিচে এক শিশুর হাসি ছিল। এখন সেই টুপি শুধু স্মৃতি। তার পাশে রক্তে ভেজা মাটিতে লেখা থাকে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা, নীতির ঔদ্ধত্য, আর মানবিকতার শূন্যতা।
কাশ্মীরের সীমান্ত যেন একটি রক্তাক্ত ডায়েরি। প্রতিটি পাতায় লেখা নিষ্পাপ জীবনের অপচয়ের গল্প। যুদ্ধবিরতির ঘোষণায় কাগজে শান্তি আসতে পারে। কিন্তু যাদের কোল শূন্য, তাদের জন্য শান্তির কোনো ঘোষণা যথেষ্ট নয়।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment