যে কথা বলেননি ভলতেয়ার
ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের সবচেয়ে বিখ্যাত উক্তি হিসেবে প্রচলিত হলো ‘তোমার মতের সঙ্গে আমি হয়তো একমত নাও হতে পারি, কিন্তু তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আমি আমার জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করে যাব।’ কথাটি কি আসলেই তিনি বলেছিলেন? আজ ৩০ মে ভলতেয়ারের মৃত্যুদিনে সে কাহিনিই জানাচ্ছেন শতাব্দীকা ঊর্মি
ফরাসি রেনেসাঁ অন্যতম পুরোধা ভলতেয়ার। তাঁর পুরো নাম ফ্রাঙ্কো ম্যারিক আরোয়েট ভলতেয়ার। তিনি ছিলেন যুক্তিবাদ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধচারণকারী এক কিংবদন্তি চিন্তক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ভলতেয়ার কি গণতন্ত্রকামী ছিলেন? উত্তরটি সরল নয়। তিনি ছিলেন গণতন্ত্রের কিছু মূলনীতি ও মূল্যবোধের অনুরাগী। কিন্তু গণতন্ত্রের কাঠামোগত রূপ বা ‘জনগণের শাসন’-এর প্রতি তেমন আস্থা রাখেননি।
এই দ্বিধা থেকেই জন্ম নেয় একটি গভীর বিশ্লেষণের ক্ষেত্র। ভলতেয়ার কীভাবে গণতন্ত্রকে চিনতেন এবং আধুনিক গণতন্ত্র কীভাবে তাঁর চিন্তাধারাকে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করেছে?
ভলতেয়ারের জীবন ছিল নিরন্তর বিতর্ক, ব্যঙ্গ ও অধিকার রক্ষার সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। তিনি বিশ্বাস করতেন একটি সমাজ তখনই পরিপূর্ণ হয়, যখন সেখানে যুক্তির চর্চা, প্রশ্ন করার অধিকার ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতা থাকে। তাঁর রচিত ‘ট্রিটিজ অন টলারেন্স’ বইয়ে তিনি এর বিশ্লেষণ করেছিলেন।
এই দর্শনই গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত।
গণতন্ত্র ও ভলতেয়ারের দ্বিধা
আশ্চর্যের বিষয়, ‘গণতন্ত্র’ শব্দটির প্রতি ভলতেয়ার তেমন উদার ছিলেন না। তিনি ছিলেন এক ধরনের ‘বিনীত একনায়কতন্ত্র’-এর পক্ষে। তাঁর বিশ্বাস ছিল, একজন ‘উন্নত বুদ্ধিসম্পন্ন’ রাজা বা শাসক যদি আলোকিত হন, তবে তিনি অধিক কার্যকর ও ন্যায্য শাসন দিতে পারেন। এক্ষেত্রে এই ফরাসি দার্শনিকের যুক্তি ছিল, অশিক্ষিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন জনগণ যদি শাসনক্ষমতায় আসে, তাহলে সমাজ আরও বিভ্রান্ত ও সহিংস হতে পারে।
এখানে ভলতেয়ারের ‘আলোকিত শাসক’ ধারণা প্লেটোর দার্শনিক রাজার সঙ্গে মিলে যায়। জনগণের শিক্ষা ও যুক্তিবোধ না বাড়লে গণতন্ত্রও হতে পারে এক ধরনের গণ-ভ্রান্তি।
তবুও ভলতেয়ার এমন কিছু নৈতিক ভিত্তি তৈরি করেন, যা আধুনিক গণতন্ত্রের প্রাথমিক ধাপ হয়ে দাঁড়ায়। যেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সহিষ্ণুতা, নির্যাতন ও জুলুমবিরোধিতা, প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও প্রশ্ন করার অধিকার।
ভলতেয়ার সরাসরি গণতন্ত্র না চাইলেও এমন এক মননভিত্তি গড়ে দেন—যেখানে যুক্তিবাদ ও মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি গণভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
আজকের গণতান্ত্রিক বিশ্বে যখন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হুমকির মুখে, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত কিংবা ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা মাথাচাড়া দিচ্ছে, তখন ভলতেয়ারের যুক্তিবাদ ও অসাম্প্রদায়িক কণ্ঠ আমাদের জন্য হয়তো আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
বলার কথা হলো, সরল অর্থে গণতন্ত্রকামী ছিলেন না ভলতেয়ার। বিপরীতে তিনি ছিলেন গণতন্ত্রের কাঠামোর প্রতি সন্দিহান। কিন্তু গণতন্ত্রের মূল্ভিত্তি মতপ্রকাশের অধিকার, প্রশ্ন করার সাহস, ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানবিক যুক্তি, এসবের তিনি ছিলেন অগ্রদূত। তাঁর দর্শন বলে, গণতন্ত্র কেবল শাসনব্যবস্থা নয়, বরং এটি একটি সাংস্কৃতিক ও নৈতিক অনুশীলন।
ভলতেয়ার স্মরণে এ লেখা শেষ করব চমকপ্রদ একটা তথ্য দিয়ে। আমরা অনেকেই জানি, ভলতেয়ার বলেছেন, ‘তোমার মতের সঙ্গে আমি হয়তো একমত নাও হতে পারি; কিন্তু তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আমি আমার জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করে যাব।’ কিন্তু চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, ভলতেয়ারের নামে প্রচলিত এই কথা আদতে ভলতেয়ারের নয়। তিনি কখনো এটি বলেননি। কথাটি বলেছিলেন ইংরেজ নারী লেখক ইভলিন বিউট্রিস, তাঁর ‘দ্য ফ্রেন্ডস অব ভলতেয়ার’ বইয়ে।
তবে ভলতেয়ার এই কথা না বললেও আজীবন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথাই বলে গেছেন। মৃত্যুদিনে তাঁকে শ্রদ্ধা।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment