×

লিঙ্গবিদ্বেষী সমাজে ভুক্তভোগীরা কেন ‘যথার্থ’ হতে পারে না

কোনো ঘটনায় অপরাধীর চেয়ে আমরা অনেক সময় ভুক্তভোগীকেই সামাজিকভাবে হেনস্তার শিকার হতে দেখি। বিজ্ঞজনেরা এই পরিস্থিতিকে বলেন ‘ভিক্টিম ব্লেমিং’। কিন্তু এই ভিক্টিং ব্লেমিং পরিস্থিতির দিকে কেন ধাবিত হয় সমাজ? দ্য ডন পত্রিকার ব্যাখা ও  শতাব্দীকা ঊর্মির বিশ্লেষণ।

১৬ মে নারীর রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী ‘নারীর ডাকে মৈত্রীযাত্রা’ নামে একটি কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে সারা দেশ থেকে সমবেত হয়েছিলেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। নেতৃত্বে ছিলেন নারীরা। সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতিতে নারী সব সময় সম্মুখযোদ্ধা হলেও নারীর অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে নারীকে থাকতে হয় পেছনে। এমনকি নারীর প্রতি সহিংসতার চিরন্তন সিলসিলা থাকা সত্ত্বেও বিচার পেতে গেলে এখনো নারীকে হতে হয় লাঞ্ছনার মুখোমুখি।

সাম্প্রতিক একটি একটা ঘটনা স্মরণ করা যাক। ১২ এপ্রিল রাতে রাজধানীর বসুন্ধরার বাসা থেকে মডেল মেঘনা আলমকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আদালত তাঁকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে ৩০ দিনের জন্য আটক রাখার আদেশ দেন। ফলে এই আটক ঘিরে উঠেছে নানা প্রশ্ন ও সমালোচনা। কোনো মামলা বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়া, এমন কি নারী পুলিশের উপস্থিতি ছাড়াই বলপূর্বক আটক করা হয় তাঁকে। একদিকে যেমন ছিল নাগরিক মহলের প্রতিবাদ, অন্যদিকে ভুক্তভোগীর প্রতি মৌখিক আক্রমণও।

এই সমস্যা কোনো স্থানীয় সমস্যা নয়। পশ্চিমের আলাদা চেহারা রয়েছে, আলাদা চেহারা রয়েছে আফ্রিকা বা উপমহাদেশে। প্রায়ই দেখা যায়, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কোনো ভুক্তভোগীই কখনো ‘যথার্থ’ হতে পারে না। বিশেষ করে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে ভুক্তভোগীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে দাঁড়ায় বিচারপ্রক্রিয়ার কেন্দ্র। যেখানে নারীকে বিচার চাইতে গিয়ে আরও একবার সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে বিচারের বদলে নিন্দা সহ্য করতে হয় সেখানে কোর্টের পক্ষ থেকেও বিচারপ্রার্থী নারীর প্রতি কিছু ‘অসংবেদনশীল’ মন্তব্য করা হয়। । কেন ভুক্তভোগীদের ক্ষেত্রে এমন বিমূখ হয় সমাজ? ‘দ্য ডন’ সম্প্রতি এই বিষয়ে একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করে।

২০ মে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট নূর মুখাদ্দাম হত্যা মামলায় প্রধান আসামি জাহির জাফরের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। এটি ছিল এক প্রতীকী জয়। বিশেষ করে নারীর প্রতি সহিংসতার বিচারপ্রক্রিয়ায়, যেখানে সুবিচারের ঘটনা বিরল। কিন্তু এই জয়গাথার মধ্যেও ছায়া ফেলে বিচারপ্রক্রিয়ায় উচ্চারণ হওয়া কিছু মন্তব্য। শুনানির সময় অভিযুক্ত ও ভুক্তভোগীর মধ্যে সম্পর্ককে কেন্দ্র করে এক বিচারপতি বলেন, ‘বিবাহবহির্ভূত সহাবস্থান ধর্ম ও নৈতিকতার পরিপন্থী। এটা ইউরোপে হয়, এখানে না।’

বিচারপতির কাজ অপরাধের বিচার করা, নৈতিক উপদেশ দেওয়া নয়। যদিও মন্তব্যটি অভিযুক্ত ও ভুক্তভোগী উভয়কে উদ্দেশ্য করেই করা হয়, বাস্তবে নারীর দিকেই পড়ে দোষারোপের ভার। এই ধরনের বক্তব্য আদালতকক্ষেই পুনরায় নিপীড়নের জন্ম দেয়, যা বিচারপ্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

পাকিস্তানের একাধিক মামলার রায়েই দেখা যায় আদালত ভুক্তভোগীর বয়স, বৈবাহিক অবস্থা বা সম্পর্কের অতীতকে রায়ে যুক্তি হিসেবে আনা হয়। উদাহরণস্বরূপ আমির ‘রাজ্জাক ভার্সেস দ্য স্টেট’ (২০১৯) নামে এক মামলায় আদালত ভুক্তভোগীর বয়স ও আগের বিবাহিত জীবনকে ‘স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ’-এর প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করে। আর ‘মুহাম্মদ জাভেদ ভার্সেস দ্য স্টেট’ (২০২২) নামে অপর মামলায় ১৬ বছর বয়সী ভুক্তভোগীর শারীরিক পরিপক্বতা ও কর্মস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর বক্তব্যকেই অবিশ্বস্ত মনে করা হয়।

এমন ‘আদর্শ ভুক্তভোগী’ ধারণা সমাজে দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে। যেন নারীকে সহানুভূতি পেতে হলে শারীরিকভাবে দুর্বল, সম্পর্কবিহীন, ‘ভদ্র’ ও নিখুঁত হতে হয়। একটু ‘ভিন্ন’ হলেই বিচারব্যবস্থার চোখে তার বক্তব্য দুর্বল হয়ে পড়ে। অথচ বাস্তবতা হলো সহিংসতার শিকার নারীরা। পরিচিতজন, পরিবার এমনকি স্বামীদের হাতেও নিপীড়নের শিকার হন।

‘মুহাম্মদ ইমরান ভার্সেস দ্য স্টেট’ (২০২৪) মামলায় অভিযুক্ত দাবি করেন, ভুক্তভোগীর সঙ্গে তাঁর পূর্বের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু বিচারপতি আয়েশা এ মালিক স্পষ্টভাবে জানান, যৌন ইতিহাস কোনোভাবেই সম্মতির প্রমাণ নয়। এর আগেই ২০২১ সালে বিচারপতি মানসুর আলী শাহ একই দৃষ্টিকোণ থেকে মত দেন নারীর চরিত্র নয়, বিচার হবে অপরাধের ভিত্তিতে।

এই প্রসঙ্গে ‘শাহজাদ আহমেদ ভার্সেস দ্য স্টেট (২০২৫)’ মামলায় বিচারপতি বিচারক সত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন, ‘বিচারকদের সচেতন থাকা প্রয়োজন যেন তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি রায়ের ওপর প্রভাব না ফেলে।’ এই মন্তব্য আশা জাগায় যে বিচারব্যবস্থার ভেতর থেকেই পরিবর্তনের দাবি আসছে।

লিঙ্গ সংবেদনশীলতা এখন সময়ের দাবি। বিচারক থেকে শুরু করে পুলিশ, আইনজীবী সবারই প্রয়োজন লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতাসংক্রান্ত প্রশিক্ষণ। আদালত কক্ষ যেন ভুক্তভোগীর দ্বিতীয় শাস্তির জায়গা না হয়, বরং হওয়া উচিত তার নিরাপত্তার আশ্রয়। সংবিধান যেভাবে মর্যাদা ও গোপনীয়তার অধিকার দিয়েছে, বিচারব্যবস্থাও সেই মূল্যবোধে পরিচালিত হওয়া উচিত।

ঠিক এমন কিছু খারাপ ধারণার বিহিত চাইতেই নারীর ডাকে মৈত্রীযাত্রা কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন নারীরা। সমতার দাবীতে ৩১টি স্লোগান নিয়ে শহর জুড়ে মিছিল করেন তারা। অধিকারের পক্ষের এই কর্মসূচির জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদেরকে বেশ্যায়ন করা হয়।

দ্য ডনের বিশ্লেষণ মতে, ‘আদর্শ ভুক্তভোগী’ নামের সামাজিক বিভ্রমকে ভেঙে দিতে হবে। বিচার মানে ভিকটিমের চরিত্র বিশ্লেষণ নয়, বরং অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা। শব্দ, দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিবেশ সবকিছুর বদল জরুরি। বিচার তখনই সম্পূর্ণ হয়, যখন একজন ভুক্তভোগী আদালত থেকে সম্মান নিয়ে বের হতে পারেন। ভীত বা অপমানিত হয়ে নয়।

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment