জলবায়ু ২: দুনিয়ায় কি প্রভাব ফেলছে জলবায়ু পরিবর্তন?
জাতিসংঘের ক্লাইমেট অ্যাকশনের তথ্য অনুসারে, ভূ–পৃষ্ঠে গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ বৃদ্ধি পাচ্ছে আঠারো শ শতকের শিল্প বিপ্লবের শুরু থেকে থেকে। ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে। এই পরিবর্তনের ফলে হিমশৈল গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সমুদ্রের পানির লবন লোকালয়ে ঢুকে পানি ও মাটির লবনাক্ততা বাড়িয়ে তুলছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে গেছে, পরিবর্তিত জলবায়ুতে টিকতে না পেরে পৃথিবীর নানা স্থানে প্রাণীকুল বিপন্ন, কিছু প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যূত হচ্ছে মানুষ, জীবন জীবিকা বিপন্ন হয়ে পড়ছে।
জাতিসংঘ বলছে, গি্রনহাউজ গ্যাসের ঘনত্ব যত বাড়ছে, পৃথিবীপৃষ্ঠের তাপমাত্রাও তত বাড়ছে। গত দশক ২০১১ থেক ২০২০ সাল বিশ্বের ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার ছিল। ১৯৮০ সাল থেকে প্রতি দশকে তাপমাত্রা বেড়েছে। বিশ্বের প্রায় সব অঞ্চলই সর্বোচ্চ তাপপ্রবাহ দেখেছে। উচ্চ তাপমাত্রার কারনে মানুষ নানা ধরনের অসুস্থ্যতার শিকার হচ্ছে এবং মানুষের কর্মক্ষমতা কমে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের বেশকিছু অঞ্চলে মারাত্মক দুর্যোগের মুখোমুখি হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন পানির সংকট তৈরি করছে ফলে বিভিন্ন এলাকায় খরা দেখা যাচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, প্রাণীকুলের প্রজাতি বিপন্ন হচ্ছে, খাদ্যঘাটতি দেখা যাচ্ছে, স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বাড়ছে, দারিদ্র্য এবং বাস্তুচ্যুতি হচ্ছে।
চীনের বেইজিংয়ের চায়নিজ একাডেমি অব সায়েন্সের ইনস্টিটিউট অব অ্যাটমোস্ফেরিক ফিজিকসের বার্ষিক বিশ্লেষণে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পাঁচ বছর ধরে সমুদ্রের উষ্ণতা ধরে রাখার ক্ষমতা ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। ২০১৯ সাল থেকে মহাসাগরগুলো রেকর্ড হারে উষ্ণ হচ্ছে। ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে সমুদ্রের প্রথম ২ হাজার মিটার এলাকায় সঞ্চিত তাপ ১৫ জেটাজুল (শক্তি পরিমাপের একক) বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর এই মাত্রা ছিল ১০ দশমিক ৯ জেটাজুল। জাপানের হিরোশিমাতে যে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়, তেমন পাঁচ থেকে ছয়টি বোমার সমান তাপ সমুদ্র প্রতিদিন ধারণ করছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাসাগরীয় এবং বায়ুমন্ডলীয় প্রশাসনের (National Oceanic and Atmospheric Administration) তথ্য অনুযায়ী, ১৯০১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বিশ্বের তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা সাধারণত প্রতি বছর ১.৭ মিলিমিটার হারে বাড়ে কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত এই পরিবর্তনের হার ছিল ৩.২ মিলিমিটার। আগে যে গড় মাত্রায় বরফ গলতো এখন তার চেয়ে বেশি মাত্রায় গলছে। বিশ্বের ৩০ টি হিমবাহকে ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ১৯৮০ সাল থেকে এ গুলোর পরিধি ৬০ ফুটের বেশি করে কমেছে। গ্রীষ্মের শেষের সময়গুলোতে আর্কটিকের সামুদ্রিক বরফ দ্বারা আচ্ছাদিত এলাকা ১৯৭৯ সাল থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। ১৯৫৮ সাল থেকে বায়ুমন্ডলে কার্বন–ডাই–অক্সাইডের পরিমাণ ২৫ শতাংশ এবং শিল্প বিপ্লবের পর থেকে ৪০ শতাংশ বেড়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন তাপদাহ, দাবানল, বন্যা, গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঝড় ও হারিকেনকে সরাসরি প্রভাবিত করছে। এবং এগুলোর কারণে মানবিক বিপর্যয়ের তীব্রতা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। বিশ্বের ৩৬০ কোটি মানুষ ইতিমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের উচ্চ ঝুঁকিতে আছে এবং ২০৩০ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে দুই লাখ ৫০ হাজার মানুষ ডায়রিয়া, অপুষ্টি, ম্যালেরিয়া এবং হিট স্ট্রেসের কারণে মারা যাবে। ২০৩০ সাল নাগাদ স্বাস্থ্যের ওপর ২০০ থেক ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার সমমূল্যের ক্ষতিকর প্রভাব সরাসরি পড়বে। স্বাস্থ্য অবকাঠামোগত দূর্বল অঞ্চল বিশেষত উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো সহযোগিতা না পেলে ঝুঁকি মোকাবিলা করতে পারবে না।
আইপিসিসি’র পঞ্চম মূল্যায়ন প্রতিবেদনে কীটপতঙ্গ বাহিত রোগের বিস্তৃতি এবং সংক্রমণ পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে (২০১৫), গ্রিন হাউজ গ্যাসের নিঃসরণ বর্তমান হারে চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ বায়ুর গড় তাপমাত্রা ১.৪ ডিগ্রি সে. এবং ২১০০ সাল নাগাদ ৪.৮ ডিগ্রি সে. বৃদ্ধি পাবে। জাতিসংঘের দুর্যোগ ঝুঁকি প্রশমনবিষয়ক দপ্তর (ইউএনডিআরআর) বলছে, চলতি দশক অর্থাৎ ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে দুর্যোগের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে বছরে ৫৬০টি, যা দৈনিক গড়ে দুটির কাছাকাছি। সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সর্বশেষ দুই দশকে প্রতি বছর ৩৫০ থেকে ৫০০টি মধ্যম থেকে ভয়াবহ দুর্যোগের শিকার হয়েছে বিশ্ববাসী।
আন্তর্জাতিক গবেষণা পত্রিকা ‘জার্নাল পিডিয়াট্রিক অ্যান্ড পেরেনিট্যাল এপিডিমিয়োলজি’র বিশেষ সংখ্যায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইসরায়েলসহ বেশকিছু দেশে জন্মের এক বছরের মধ্যে শিশুদের অস্বাভাবিকভাবে ওজন বাড়ছে। ফলে ৫ থেকে ১০ শতাংশ শিশু অস্বাভাবিক স্থূলত্ব নিয়ে বেড়ে উঠছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, এ মুহূর্তে বিশ্বের অন্তত ১৮ শতাংশ শিশুই অস্বাভাবিক ওজন বা স্থূলত্বে ভুগছে। বলা হয়েছে, দাবানলের ধোঁয়ার জন্য মাতৃগর্ভে থাকা ভ্রুণের জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার বিপদ ২৮ শতাংশ বেড়ে গেছে। সেটা হচ্ছে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার প্রথম তিন মাসেই। যুক্তরাষ্ট্র, ডেনমার্ক, ইসরায়েল, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গবেষণা চালিয়ে এই জার্নালের প্রতিবেদনগুলো তৈরি করা হয়েছে।
আইপিসিসির সর্বশেষ (ষষ্ঠ) মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈশ্বিক তাপমাত্র বৃদ্ধির হার ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে সীমাবদ্ধ রাখতে হলে ২০৫০ সালের মধ্যে কয়লা, তেল এবং গ্যাসের ব্যবহার ২০১৯ সালের তুলনায় যথাক্রমে ৯৫%, ৬০% এবং ৪৫% কমাতে হবে।
আইপিসিসির ষষ্ঠ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বেশকিছু অনুমান তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীতে একাধিক দেশে ঘনঘন বন্যা হবে, সমুদ্রে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে ছোট দ্বীপ ও বদ্বীপ এবং নিচু অঞ্চর সাগরে বিলীন হয়ে যেতে পারে, উষ্ণ অঞ্চলগুলোতে তাপপ্রবাহ বৃদ্ধি পাবে, ফলে কৃষিজমি মরুভূমিতে পরিণত হতে পারে, আফ্রিকার অনেক দেশে খরার প্রকোপ বাড়তে পারে এবং এর পরিণতিতে খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির সম্মুখীন হবে, বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে, বন্যার ঝুঁকি এবং খাদ্য সংকট বাড়বে, ফসল উৎপাদন এবং পানি সংকট সৃষ্টি হবে, হুমকির মুখে পড়বে মানুষের স্বাস্থ্য। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব হবে তীব্র, কোনকিছুই এর প্রভাবের বাইরে থাকতে পারবে না এবং এই পরিবর্তনগুলোকে আর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়াও যাবে না।
এই প্রতিবেদনে মানুষের নিরাপত্তা ওপর যে প্রভাব পড়বে -সে সম্পর্কে খুব স্পষ্টভাবে আলোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর জন্য বিশ্ব যদি পদক্ষেপ গ্রহণ না করে, এবং জলবায়ু পরিবর্তন যদি এভাবে বাড়তেই থাকে তাহলে মানব সমাজ কাঠামোর যে স্থিতিশীলতা সেটাই বিপন্ন হয়ে পড়বে।’
জাতিসংঘের সহযোগী বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডাব্লিউএমও) ‘স্টেট অব গ্লোবাল ওয়াটার রিসোর্সেস ২০২১’ প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩৬০ কোটি মানুষ সুপেয় পানির সংকটে ভুগছে। তারা বছরে অন্তত এক মাস এ ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। এ প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০৫০ সাল নাগাদ পানি সংকটে ভুগতে পারে বিশ্বের ৫০০ কোটি মানুষ। জার্মানির বন শহরে অনুষ্ঠিত ‘গ্লোবাল ওয়াটার সিস্টেম প্রজেক্ট’ শীর্ষক এক বৈঠকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ৫০০ বিজ্ঞানীর এক যৌথ ঘোষণাপত্র অনুযায়ী মানুষের কর্মকান্ড (যেমন ভূমিধস, দূষণ, নদী খনন ইত্যাদি) বিশুদ্ধ পানির সরবরাহে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment