×

জলবায়ু ৩: জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে জাতিসংঘ কি করেছে?

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য জাতিসংঘ নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রণয়ন করেছে বিভিন্ন নীতিমালা এবং প্রতি বছর কপ সম্মেলনের মাধ্যমে বিশ্বব্যপী সচেতনতা বৃদ্ধিসহ নানা ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।

জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ১৯৭২ সালে স্টকহোম সম্মেলনের (ইউএন কনফারেন্স অন দ্যা হিউম্যান এনভায়রনমেন্ট) মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিবেশ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান গঠন ও জাতীয় পরিবেশ কর্মপরিকল্পনা বা নীতি গ্রহণ করা হয়। এ সম্মেলনের আওতায় জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) প্রতিষ্ঠা করা হয়।

১৯৮৮ সালে ইউএনইপি ও বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) যৌথ উদ্যোগে জলবায়ু সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ের বিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে আন্তঃসরকার জলবায়ু পরিবর্তন প্যানেল–আইপিসিসিগঠন করা হয়। পৃথিবীজুড়ে কয়েক হাজার বিজ্ঞানী ও বিশ্লেষক স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে আইপিসিসির সঙ্গে যুক্ত আছেন। বৈজ্ঞানিক তথ্য দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক জাতিসংঘ কর্মকাঠামো সনদ (ইউএনএফসিসিসি)-কে সহায়তা করাই আইপিসিসি’র দায়িত্ব। এ উদ্দেশ্যে আইপিসিসি মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং প্রশমন ও অভিযোজন বিষয়ে মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করে থাকে। প্রতিবেদন তৈরি করার জন্য আইপিসিসি কোনো গবেষণা পরিচালনা করে না বরং স্বীকৃত গবেষণার ফলাফল সমন্বয় করে। জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা সম্পর্কে বিশ্বকে জানানোর জন্য নিরলস কাজ করার স্বীকৃতিস্বরূপ আইপিসিসিকে ২০০৭ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৬ টি মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আইপিসিসি।

মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে ধরিত্রী সম্মেলনে (আর্থ সামিট) ইউনাইটেড ন্যাশন’স ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (ইউএনএফসিসিসি) গঠনের প্রস্তাব করা হয়। ওই সম্মেলনে এ সংক্রান্ত একটি সনদ প্রণয়ন করা হয়। ১৯৯৪ সালের ২১ মার্চ থেকে এই সনদ কার্যকর করা হয়। ২০২৩ সাল পর্যন্ত এ সনদে বিশ্বের ১৯৮ টি দেশ সই করেছে। সনদে সই করা দেশগুলো প্রতিবছর একবার জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য আলোচনায় বসে। এই বৈঠককে কনফারেন্স অব পার্টিজ বা কপ বলা হয়। ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২৮ টি কপ সম্মেলন হয়েছে। এ গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো– ১৯৯৭ সালের কিয়োটো সম্মেলন (কপ ৩) যেখানে কিয়োটো প্রটোকল প্রণয়ন করা হয়। ২০০৭ সালের বালি সম্মেলন (কপ ১৩), ২০১০ সালের কানকুন সম্মেলন (কপ ১৬), ২০১৫ সালের প্যরিস সম্মেলন (কপ ২১)। কপ সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য হলো– জলবায়ুর ওপর মানুষের বিপজ্জনক হস্তক্ষেপ প্রতিরোধ করার মাধ্যমে বায়ুমন্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের ঘনত্ব নির্দিষ্ট স্তরে স্থির রাখা।

কিয়োটো সম্মেলনে শিল্পোন্নত দেশগুলো গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন বাধ্যতামূলকভাবে কমানোর লক্ষ্য নিয়ে কিয়োটো প্রটোকলে স্বাক্ষর করে। কিয়োটো চুক্তির ভিত্তিতে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ২০১২ সালের মধ্যে ৫.২ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। চুক্তিমতে, যুক্তরাষ্ট্র ৭ শতাংশ, ইউরোপীয় দেশগুলো ৮ শতাংশ, জাপান ৬ শতাংশ, কানাডা ৬ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করবে বলে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল। কিন্তু বাস্তবে খুব বেশি ভূমিকা পালন করেনি। বরং সবচেয়ে বেশি গ্যাস নির্গমনকারী দুটি দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া কিয়োটো প্রটোকলের বিরোধিতা করে।

বালি সম্মেলনে বালি রোডম্যাপ প্রণয়ন করা হয়। এর লক্ষ্য ছিল কিয়োটো প্রটোকলের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ আরো কমাতে ২০০৯ সালে কোপেনহেগেনে একটি ঐকমত্যে পৌঁছানোর পথ প্রশস্ত করা। এ কর্মপরিকল্পনায় দুটি ওয়ার্কিং গ্রুপকে সময়সীমা বেধে দেওয়া হয়। একটি গ্রুপের কাজ ছিল বালি অ্যাকশন প্ল্যানের বাস্তবায়ন দেখা। অন্যটির দায়িত্ব ছিল ২০১২ সালের পর অ্যানেক্স ১ দেশগুলোর প্রস্তাবিত নিঃসরণ হ্রাস নিয়ে আলোচনা করা।

কানকুন সম্মেলনে বছরে ১০ হাজার কোটি ডলারের গ্রিন ক্লাইমেট তহবিল গঠন ও এর অর্থ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে সহজভাবে ভাগ করে দেওয়ার লক্ষ্যে আমেরিকা, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রস্তাবনায় জাতিসংঘে ট্রাস্টি গঠনের মাধ্যমে অর্থ বণ্টনের নীতিমালা গঠন করা হয়। 

২০১১ সালের ডারবান সম্মেলনে গি্রন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ) গঠন করা হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচেনে এর সদরদপ্তর অবস্থিত। উন্নয়নশীল দেশ থেকে ১২ জন এবং উন্নত দেশ থেকে ১২ জন, মোট ২৪ জন সদস্য নিয়ে জিসিএফ পরিচালনা পর্ষদ গঠিত। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলার জন্য ২০২০ সাল নাগাদ প্রতিবছর উন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রুত ১০ হাজার কোটি ডলার কার্যকরভাবে ব্যবহার করাই গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ)-এর দায়িত্ব।

২০১৪ সালের সম্মেলনে ১৯৬টি সদস্য দেশের মধ্যে ১২৯টি দেশ নিজস্ব ‘জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান এনডিসি’ পেশ করে। অধিকাংশ দেশই ২১০০ সাল নাগাদ ‘তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রশমন কর্মসূচির পাশাপাশি অভিযোজন এবং মিশ্র-কর্মসূচির প্রতিশ্রুতিও পেশ করে। 

প্যারিস চুক্তিতে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার ক্ষেত্রে বিশ্বের দেশগুলো একমত হয়। এই চুক্তিতে ১৯৬ টি দেশ সই করে প্রতিশ্রুতি দেয় যে, ২১০০ সালের মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা ২.০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বজায় রাখা এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে দেশগুলো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এই চুক্তিতে পরিবেশগত কর্মসূচিতে সহায়তার জন্য বিশ্বের ধনী ও উন্নত দেশগুলোকে ২০২০ সালের পর থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বার্ষিক তহবিল গঠনের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়।

২০২৩ সালের দুবাই সম্মেলনের ‘ওয়ার্ল্ড ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিটে’ ১৫৪ টি রাষ্ট্র ক্ষয়ক্ষতি তহবিলের (লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড) বিষয়ে ঐতিহাসিক অঙ্গীকার করে। ৭০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি তহবিল ঘোষিত হয়। এ ফান্ডের মূল লক্ষ্য জলবায়ু পরিবর্তনের অনিবার্য ঝুঁকি থেকে উদ্ভূত নেতিবাচক পরিণতি মোকাবিলা করার জন্য দরিদ্র দেশগুলিকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা।

সর্বশেষ কপ সম্মেলন হয়েছে আজারবাইজানের বাকুতে। ২০২৪ সালের ১১ থেকে ২২ নভেম্বর অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে শেষ পর্যন্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে বার্ষিক ৩০ হাজার কোটি ডলার পাওয়ার প্রতিশ্রুতি মিলেছে৷  যদিও এই অর্থ উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম৷

চুক্তিতে বার্ষিক এক দশমিক তিন ট্রিলিয়ন ডলারের বিস্তৃত জলবায়ু অর্থায়নের লক্ষ্য অর্জনের কথাও রাখা হয়েছে৷ এরমধ্যে সরকারি ও বেসরকারি দুই তহবিলই থাকছে৷ যদিও এটিকে’ বিশ্বাসঘাতকতা’ ও ‘অপমানজনক’ বলে আখ্যায়িত করছে উন্নয়নশীল দেশগুলো ও জলবায়ু কর্মীরা।

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment