×

জলবায়ু ৪: বাংলাদেশের কি হাল বানিয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন

২০০০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ১৮০টি দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের তথ্য নিয়ে বার্লিনভিত্তিক সংস্থা জার্মান ওয়াচ বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচক ২০২১ প্রকাশ করেছে। সূচক অনুসারে সবচেয়ে বেশি জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা শীর্ষ ১০ টি দেশ হলো যথাক্রমে পুয়ের্তোরিকো, মিয়ানমার, হাইতি, ফিলিপাইন, মোজাম্বিক, বাহামা, বাংলাদেশ পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও নেপাল। এই তালিকায় বাংলাদেশের স্থান সপ্তম।

এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণ ২০৫০ সাল নাগাদ মোট জিডিপির ২ শতাংশ এবং ২১০০ সাল নাগাদ ৯.৪ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ২০১৫ সালে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে শুস্ক মৌসুমে কম ও বৃষ্টির মৌসুমে অধিক বৃষ্টিপাত হবে।

বিজ্ঞানীদের ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে তাপমাত্রা বৃদ্ধির বর্তমান হার অব্যাহত থাকলে ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১১ থেকে ৩৮ ইঞ্চি পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। আইপিসিসির চতুর্থ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়, সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে এই শতাব্দীর মধ্যে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা ডুবে যেতে পারে। দেশের ১৯টি জেলার প্রায় ৬০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা ডুবে যাওয়ার ঝুঁকির মধ্যে আছে। এ কারণে প্রায় ২ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যূত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নাসার সাম্প্রতিক একটি গবেষণা বলছে, আগামী ১০০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের বন্দরনগরী চট্টগ্রাম সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। 

ইউনিসেফ ২০১৯ সালে জলবায়ু ঝুঁকি সূচক বা চিলড্রেনস ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স প্রকাশ করে। এই ইনডেক্স অনুসারে, বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৩ দেশের মধ্যে ১৫তম। ইউনিসেফ বলছে, বাংলাদেশের এক কোটি নব্বই লাখেরও বেশি শিশুর জীবন সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিতে রয়েছে।

মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট লবণাক্ততার কারণেই প্রতিবছর উপকূলীয় জেলাগুলোতে খাদ্যশস্য উৎপাদন কমেছে ৩০ লাখ ২৭ হাজার টন। লবনের মাধ্যেম ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ ৮ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ‘ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্ল্যান অব বাংলাদেশ (২০২৩-২০৫০)’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের দক্ষিণের ১৯ জেলার চাষযোগ্য জমির প্রায় অর্ধেকই লবণাক্ততায় ডুবে আছে। ২০০০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত নতুন করে লবণাক্ততার মুখে পড়েছে ৩৫ হাজার ৪৪০ হেক্টর জমি।

বাংলাদেশ প্রকৃতিগতভাবেই প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) বৈশ্বিক জলবায়ু সূচক-২০২১ এর একটি প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝুকির ক্রমানুসারে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। গত ২০ বছরে বাংলাদেশে ১৮৫টি বড় দুর্যোগ আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, পাহাড়ধসের মতো দুর্যোগ রয়েছে। যা মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব। এ সব দুর্যোগে ১১ হাজার ৪৫০ জন মানুষ মারা গেছেন আর আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩৭২ কোটি ডলার। 

অর্থ মন্ত্রণালয়ের ২০১৮ সালে প্রকাশিত– ‘টেকসই উন্নয়নে জলবায়ু অর্থায়ন ২০১৮–১৯’ শীর্ষক বাজেট প্রতিবেদনে বিনিয়োগের দৃশ্যপট সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষার বরাত দিয়ে বলা হয়, ১৯৯৮ এর বন্যায় বাংলাদেশের তিনভাগের দুইভাগ অংশ পানির নীচে তলিয়ে যায় এবং ২ বিলিয়ন ডলারের ওপর আর্থিক ক্ষতি হয় জিডিপির এর ৪.৮ শতাংশ। একইভাবে, ২০০৭ সালে সাইক্লোন সিডরের ক্ষতির অঙ্ক ১.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা জিডিপির ২.৬ শতাংশ। গত এক দশকে অবকাঠামো, জীবিকা এবং ফসলের ক্ষতির হিসাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগে জাতীয় অর্থনীতিতে গড় ক্ষতির পরিমাণ জিডিপির ০.৫ থেকে ১.০ শতাংশের সমান হবে।

ভারতের ট্রপিক্যাল মেটেরোলজি ইনস্টিটিউটের জলবায়ু বিজ্ঞানী ড. রক্সি ম্যাথিও কল-এর তথ্যমতে, বিশ্বের ভয়াবহতম ১০ ঘূর্ণিঝড়ের ৮টিই সৃষ্টি হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বিশ্বে যত মৃত্যু ঘটেছে, তার ৮০ শতাংশই হয়েছে এই অঞ্চলে। এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির প্রবণতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় ১৯ জেলার প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ চরম ঝুঁকিতে রয়েছেন।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে দেশের উপকূলে আঘাত হানা ৯টি ঘূর্ণিঝড়কে মেজর (বড়) তালিকায় রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর আঘাত হানা ঝড়ে প্রাণহানি ঘটে ৩ লাখ মানুষের। ওই ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২৪ কিলোমিটার। আর জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল ৬ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত।

একই গতিবেগের ঝড় উপকূলে আবারও আঘাত হানে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল। তাতে প্রাণহানি হয়েছিল ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮২ জনের। তবে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর একই গতিবেগের ঝড় আঘাত হানলেও প্রাণহানি হয়েছিল মাত্র ৩ হাজার ৩৬৩ জনের।

আইপিসিসির ষষ্ঠ মূল্যায়নের ওয়ার্কিং গ্রুপ-২ থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ৯ থেকে ২১ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়া হতে পারে। কেবল সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে চলতি শতকে দেশের কিছু কিছু অঞ্চলের কৃষি উৎপাদন ৩১ থেকে ৪০ শতাংশ কমে যেতে পারে। একই কারণে দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর এক-তৃতীয়াংশ স্থানান্তর করার প্রয়োজন হতে পারে।

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে লবণাক্ততা, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি এবং অন্যান্য জলবায়ু সংক্রান্ত বৈরি প্রভাবের কারণে বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি ৩৩ লাখ উপকূলীয় মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারেন।

ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইন্ডিকেটরস টুল ভারসন–২ অনুসারে বাংলাদেশ বৈশ্বিক গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরনের মাত্র ০.৩৫ শতাংশ নির্গমন করে। আইপিসিসি প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৫৫ শতাংশ গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন হয় এনার্জি সেক্টর থেকে। এবং বাংলাদেশে উৎপাদিত নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে মাত্র ২.০৮ শতাংশ জ্বালানি চাহিদা পূরণ করা হয়।

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment