×

‘তোমাকে চাই’: তেত্রিশ বছর কেটেছে, কথাও রেখেছেন কবীর সুমন

১৯৯২ সালের এই দিনেই (২৩ এপ্রিল) বেরিয়েছিল কবীর সুমনের প্রথম অ্যালবাম ‘তোমাকে চাই’। তেত্রিশ বছর কেটে গেলেও কবীর সুমন কথা রেখেই চলছেন। এখনো তিনি গানে নিয়মিত। বাধা পেরিয়ে অ্যালবাম প্রকাশের গল্প, কেনো শ্রোতারা গ্রহণ করেছিল এবং ‘তোমাকে চাই’-এর ‘তুমি’র সন্ধান করেছেন গৌতম কে শুভ

২৩ এপ্রিল ১৯৯২। নিরীহ তারিখ মনে হলেও দিনটি বাংলা গানের ইতিহাসে একটা মোড় ঘোরানোর দিন। এই দিনে মুক্তি পেয়েছিল কবীর সুমনের প্রথম একক অ্যালবাম ‘তোমাকে চাই’। তাতে ছিল ১২টি গান। আজ ৩৩ বছর পর, আমরা জানি, সেই দিনটি আধুনিক বাংলা গানে নতুন ধারার সূচনার দিন। 

তবে নতুন কিছুর জন্ম তো সহজে হয় না। জন্ম মানেই যন্ত্রণা। এই অ্যালবাম প্রকাশের পথও খুব সহজ ছিল না। অনেক বাধা আর কাকতালীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে ‘তোমাকে চাই’ আলোর মুখ দেখেছিল।

কীভাবে বেরিয়েছিল ‘তোমাকে চাই’

সুমনের লেখা-সুরে এই অ্যালবামটি প্রথমে কোনো রেকর্ড কোম্পানি প্রকাশ করতে চায়নি। গ্রামোফোন কোম্পানি অফ ইন্ডিয়ার (এইচএমভি) কলকাতা অফিসের বাঙালি বড় কর্মকর্তারা সুমনের এই কাজটিকে গুরুত্ব দেননি। তাদের মনে হয়েছিল, এই গান বাজারে চলবে না। প্রথমে অ্যালবামটি পরীক্ষামূলকভাবে এইচএমভি’র নতুন একটি বিভাগ থেকে কিছু কপি বের করা হয়েছিল পরিবেশকদের দেওয়ার জন্য। পরিবেশকরা অ্যালবামটির সৌজন্য কপি ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল। কারণ, তাদেরও মনে হয়েছিল, এটা কেউ কিনবে না, প্রচলিত ধারার গান নয়। 

এরপর অ্যালবামটি আলোর মুখ দেখেছিল এইচএমভির মুম্বাই অফিসের একজন অবাঙালি বড় কর্মকর্তার হাত ধরে। তিনি মুম্বাই থেকে কলকাতা এসেছিলেন নিজে গান শুনে বিচার করতে, কোনটা চলবে আর কোনটা চলবে না। তিনি টেবিলের নিচে পড়ে থাকা সেই ‘তোমাকে চাই’ এর ক্যাসেটটি দেখতে পান। তিনি গানগুলো শুনতে চাইলে কলকাতা অফিসের লোকজন এক প্রকারে বাধা দিয়ে বলেছিল, এটা ফালতু। কিন্তু ঝা সাহেব (মুম্বাই অফিসের সেই কর্মকর্তা) খানিকটা জেদ করেই অ্যালবামটি শুনেছিলেন। 

গানগুলো শোনার পর তিনি এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, সঙ্গে সঙ্গে এই অ্যালবামের ৩০ হাজার কপি প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাঁর কড়া আদেশ ছিল, পরদিন থেকেই যেন দোকানে দোকানে সরবরাহ শুরু হয়। এক মাসের মধ্যেই আরও ৩০ হাজার কপি বাজারে আনতে হয়, কারণ অ্যালবামটি বিক্রি শুরু হতে থাকে ঝড়ের গতিতে। ছকের বাইরে গিয়ে নতুন ধরণের গানের অ্যালবাম ৬০ হাজার কপি বিক্রি হওয়াটাও সেসময় আশ্চর্যজনক ছিল। 

মানুষ তখন রেডিও শুনত। কিন্তু কবীর সুমনের এই অ্যালবাম প্রকাশের পর কোনো গান কলকাতার আকাশবাণী রেডিও থেকে প্রচারিত হয়নি। কারণ আকাশবাণী রেডিওতে মিউজিক ক্যাসেট বাজানোর নিয়ম ছিল না, রীতি ছিল শুধু গ্রামোফোন ডিস্ক বাজানোর। আর ‘তোমাকে চাই’ বেরিয়েছিল ক্যাসেট হিসেবে। এত কিছুর পরেও গানগুলো সাধারণ শ্রোতাদের কাছে পৌঁছাতে পেরেছিল শুধু মানুষে-মানুষে মুখে-মুখে ছড়ানোর ফলেই।

কেন সাড়া ফেলেছিল

নাগরিকের চেনা শব্দ নতুনভাবে এসেছিল কবীর সুমনের গানে। গানে জীবনের গল্প বুনেছিলেন তিনি। আগে গান মানে ছিল দূরের স্বর, নিখুঁত রেকর্ড ভার্সন, কিংবা বড় আয়োজনে (কম্পোজিশনে) বাঁধা কিছু। কিন্তু সুমনের গান শুনিয়েছিল, গান মানে ঘরোয়া একটা গলা, দুলে ওঠা শব্দের মাঝে এক রাশ আবেগ, আর জীবনের সাধারণত্ব। ‘তোমাকে চাই’ যেন বলল– তোমার নিজেরও একটা সুর আছে।

এই অ্যালবামে প্রেম যেমন ছিল, তেমনি ছিল শহর কলকাতা, ছিল রাজনৈতিক বোধ, ছিল ব্যক্তিগত হতাশা এবং সেই সঙ্গে আশার সুর। ‘পেটকাটি চাঁদিয়াল’ শুনে নতুন ধরণের লোকজ গল্পে ঢুকে পড়া যায়। ‘মন খারাপ করা বিকেল’ যেন সেই চুপচাপ থাকা মুহূর্তগুলোর সঙ্গী হয়ে উঠেছিল। আর ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু’ শক্তি হয়ে দাঁড়িয়ে যায় হতাশার বিপরীতে।

‘তোমাকে চাই’ অ্যালবামের গানগুলো শ্রোতাদের ভেতরের অগোছালো কথাগুলোকে গুছিয়ে দিয়েছিল। তখন তো সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না, টেলিভিশন লাইভও তেমন ছিল না। ছিল শুধু ক্যাসেটের ফিতে আর বন্ধুদের মুখে মুখে শোনা গানে ‘তোমাকে’ চাওয়ার ব্যাকুলতার গল্প। সুমনের গান যেন সবার, বিশেষত নগরজীবনের কথার সুর হয়ে উঠেছিল। এই গানগুলো যেন প্রতিটি মধ্যবিত্ত ঘরের নিজের কথা। সে কারণেই এই অ্যালবামটি আমাদের এই সময়েও এত আপন লাগে। 

‘তোমাকে চাই’ গানের ‘তুমি’ কে?

বিভিন্ন সময় এই প্রশ্ন উঠেছে ‘তোমাকে চাই’ এর ‘তুমি’ আসলে কে? এক ভদ্রলোক অস্ট্রেলিয়ায় সুমনকে এই প্রশ্ন করেছিলেন। সুমনের রহস্যভরা উত্তর, ‘আমার বাবার মাথার টাক। কারণ এমন টাক আমি পৃথিবীতে দেখিনি।’ সুমনের এই রসিকতা কিন্তু সেই ভদ্রলোক বুঝতে পারেননি। সুমন দেশে ফেরার সময় ভদ্রলোককে বলেছিলেন, এটা প্রেমের গান। তার রহস্যকে যেন মার্জনা করা হয়।

সুমনের নিজের কথায়, প্রেমের গান লিখে ফেলেছি- কী অন্যায় কাজ! তাঁর প্রেম, তাঁর হতাশা, তাঁর শহর – সব মিশে তৈরি হয়েছিল ‘তোমাকে চাই’। প্রথম কয়েক লাইন যেন একেবারে ব্যক্তিগত দিনলিপির মতো। মেয়েটি হারিয়ে যায়। বদলে আসে শহর কলকাতা। এই এক রূপান্তরই সুমনকে সবার চেয়ে আলাদা করে দেয়। একজন শিল্পী, যিনি প্রেম থেকে সমাজে চলে যান, ব্যক্তি থেকে শহরে। একরকম ধ্যানমগ্ন সফর। 

অ্যালবাম প্রকাশের পর কেটে গেছে তেত্রিশ বছর। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায় তেত্রিশ বছর কেটে যাবার পরে কেউ কথা না রাখলেও, কবীর সুমন কথা রেখেই চলছেন। এখনো তিনি গানে নিয়মিত। ৭৬ বছর বয়সেও মঞ্চে দেখা যায় তাকে, তাঁর নিজের গান, রবীন্দ্রসংগীত কিংবা বাংলা খেয়াল গাইতে।

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

পূর্ববর্তী পোস্ট

শিক্ষা উপদেষ্টার আশ্বাসেও কাজ হয়নি, কুয়েট ভিসির পদত্যাগের দাবিতে অনড় শিক্ষার্থীরা

পরবর্তী পোস্ট

আইয়ুব বাচ্চুর ব্যান্ডের নাম ‘এলআরবি’ হয়েছিল কনসার্ট–আয়োজকদের ভুলে, জানেন কি?

Post Comment