মা দিবস: পিংক ফ্লয়েডের ‘মাদার’ কোথায় আঘাত করে
শতাব্দীকা ঊর্মি
আজ ১১ মে, মা দিবস। সকাল থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় উঠেছে ভালোবাসার ঝড়—’মা, তুমি আমার পৃথিবী!’ ‘মায়ের পায়ের নিচে বেহেশত’, হাজার ছবি, হাজার কবিতা, আবেগে মাখামাখি ক্যাপশন। কিন্তু হঠাৎ দৃষ্টি আটকে যায় একটি লাইনে—‘মামা’স গনা মেইক অল অফ ইওর নাইটমেয়ার কাম ট্রু’- কী অদ্ভুত! এমন বাক্য কি মাকে নিয়ে বলা যায়?
মা মানে আশ্রয়, মা মানে ভালোবাসা। তাহলে পিংক ফ্লয়েডের গান ‘মাদার’-এ এই অন্ধকার কেন? কেন এই প্রশ্ন— মাদার, শুড আই ট্রাস্ট দ্য গভর্নমেন্ট? (মা, আমার কি সরকারকে বিশ্বাস করা উচিত?) কেনইবা এই সতর্কতা— মামা’স গনা কিপ ইউ রাইট হিয়ার আন্ডার হার উইং’ (মা তোমাকে আদরে আগলে রাখবে)।
কি এই পিংক ফ্লয়েড?
পিংক ফ্লয়েড ১৯৬৫ সালে লন্ডনে গঠিত একটি রক ব্যান্ড, যেটি পৃথিবীর অন্যতম ‘জনপ্রিয়’ ব্যান্ড হিসেবে খ্যাত। বাংলাদেশেও এটি বেশ জনপ্রিয়। ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে তারা দার্শনিক গানের কথা অনবদ্য লাইভ পরিবেশনার মাধ্যমে সাইকেডেলিক রক ঘরানায় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে। পরবর্তীতে তারা প্রোগ্রেসিভ রক ধারার পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠে ।
পিংক ফ্লয়েডের ‘মাদার’ গানটি আমাদের প্রচলিত মাতৃবন্দনার ধারণায় এসে আঘাত করে।
না, এই গান মা-বিরোধী নয়। বরং এটা সেই মায়ের প্রতিচ্ছবি, যিনি অতিরিক্ত ভালোবাসায় সন্তানকে মুড়ে দেন এক অদৃশ্য দেওয়ালে। ভালোবাসা যেখানে একদিন রূপ নেয় ভয়-ভীতির সীমারেখায়। যেখানে স্বাধীনতা হয় বন্দী, স্বপ্ন হয় ছিন্নভিন্ন, আর সন্তান বেড়ে ওঠে ভেতরের এক অজানা একাকীত্বে।
গানটি শুরুই হয় আতঙ্ক ও সংশয় দিয়ে, মাদার, ডু ইউ থিংক দে উইল বম্ব? (মা, তোমার কি মনে হয় তারা বোমা মারবে?)
সন্তান মাকে প্রশ্ন করছে, এই দুনিয়া কি নিরাপদ? সংশয়ী সত্তার এই প্রশ্নগুলোর মধ্য দিয়ে গড়ে উঠছে এক ব্যর্থতার ‘প্রাচীর’। এর পেছনে আছে সেই প্রাচীন প্রতিরক্ষা-ব্যূহ, যা মূলত তৈরি করছে মা নিজেই।
ভারত পাকিস্তানের এই যুদ্ধের দামামায় যখন আকাশজুড়ে যুদ্ধবিমানের গর্জন, তখন জম্মু কাশ্মীরের ব্লাকআউটে শুয়ে থাকা শিশুটির জন্য এ লাইন আর কল্পনাময় থাকে না, হয়ে ওঠে বাস্তব ভয়। হয়তো মা তাকে বাঁচার কৌশল শেখানোর আগেই সে হেরে যাবে রক্তে আঁকা মানচিত্রের কাছে।
অফকোর্স মামা’স গনা হেল্প বিল্ড দ্য ওয়াল
এখানে ‘ওয়াল’ কেবল সমাজ-রাজনৈতিক নয়, অস্তিত্বগত এক দেয়াল। যা নিরাপদ হলেও ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে বন্দিত্বের প্রতীক। নিষেধাজ্ঞায় মোড়া সুরক্ষা ধীরে ধীরে রূপ নেয় এমন এক কারাগারে, যা কখনো কখনো ভুলিয়ে দেয় মুক্ত জীবনের আনন্দ।
‘শি ওন্ট লেট ইউ ফ্লাই বাট শি মাইট লেট ইউ সিং’ (সে হয়তো তোমাকে উড়তে না দিলেও গাইতে দেবে গান) এই লাইনে ভেসে ওঠে মাতৃত্বের অন্য এক প্রতিচ্ছবি। মুক্ত ছন্দে উড়তে না পারার পেছনে যে আবেগিক দমন থাকে তা তৈরি করে এক অস্তিত্বসংকটের ট্রাজেডি।
মা দিবস কি কেবল ফুল আর কৃতজ্ঞতার দিন?
মা দিবসকে আমরা এমন একটি মুহূর্ত হিসেবে ভাবতে পারি, যেখানে ‘মা’কে নিছক উপাস্য নয়, একজন মানুষ হিসেবে দেখা যায়? এক জটিল, দ্বিধায় ভরা, ভালোবাসা ও নিয়ন্ত্রণের মিশ্রণে গড়া অস্তিত্ব হিসেবে?
‘মাদার’ গানটি এই প্রশ্নটাই তোলে—‘মা, সত্যিই কি তোমার তোলা দেয়ালটা এত উঁচু হওয়ার দরকার ছিল?’
চাইলে আমরা ভাবতে পারি ‘মাদার’ গানের এই মাকে তৈরি করেছে কোন অভাজনের ইতিহাস!
মাতৃত্ব এক অসাধারণ সম্পর্ক—যেখানে নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার ভারসাম্য সবসময়ই নড়বড়ে। পিংক ফ্লয়েড এই সম্পর্কের অন্ধকার দিকটি দেখাতে পিছপা হয়নি। মা দিবসের আনন্দঘন মুহূর্তে এমন গান হয়তো অস্বস্তি এনে দেয়, কিন্তু সত্যিকারের ভালোবাসা তো কেবল প্রশংসা নয়, প্রশ্নও করতে শেখায়।
মা নিঃসন্দেহে স্নেহ, ভালোবাসা ও নিরাপত্তার প্রতীক। কিন্তু অতিরিক্ত আশ্রয় অনেক সময় হয়ে ওঠে শৃঙ্খল। পিংক ফ্লয়েড এর ‘মাদার’ গানটি সেই বন্ধন আর বিভ্রান্তির প্রতিচ্ছবি। মা দিবসে তাই কেবল প্রশংসাই নয়, মাতৃত্বের গভীর দিকগুলিও ভাববার সময়।
বিএস/এমআই
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment