‘আ. লীগের সময় বিরোধীদের রাতে মোমবাতি জ্বালিয়ে বিচার করা হতো’
আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের ‘রাত ১০টা পর্যন্ত মোমবাতি জ্বালিয়ে বিচার’ করা হতো- এই অভিযোগ তুলেছেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী। বুধবার (১৪ মে) ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের এক শুনানিতে তিনি এই অভিযোগ আনেন।
তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, ‘আজকের আনিসুল হক, তখন তিনি সাবেক আইনমন্ত্রী, তাঁর আমলে রাত ১০টার সময়ও এই আদালতে, এই চেয়ারে বসে, মোমবাতি জ্বালিয়ে বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের বিচার হয়েছে। তাঁদের নির্বিচারে সাজা দেওয়া হতো।’
এই মন্তব্য করা হয় সেই সময়, যখন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। আদালতে তাঁর কোনো মন্তব্য না থাকলেও, তাঁর আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফারজানা ইয়াসমিনের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, এই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে আমরা আদালতে কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো প্রয়োজন মনে করিনি, কারণ এটি মামলার প্রাসঙ্গিকতার বাইরে।
অতীতের যেকোনো ঘটনার বিষয়ে এখন আদালতে ব্যাখ্যা দেওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কেউ যদি আদালতে দাঁড়িয়ে কোনো মন্তব্য করেন, সেটি কেবলমাত্র বক্তব্য হয়-তা প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত সত্য হিসেবে গণ্য করা যায় না। একটি বিচার প্রক্রিয়া পরিচালনার জন্য বহু পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমন্বয় প্রয়োজন হয়, যেখানে নির্দিষ্ট সময়সীমা মেনে কার্যক্রম চলে।
রাত ১০টা পর্যন্ত আদালত বসিয়ে বিচার করাটা বাস্তবতা-বহির্ভূত। এমন অভিযোগ তোলার চেয়ে বরং যিনি অভিযোগ করেছেন, তাঁরই উচিত প্রমাণ উপস্থাপন করা-কারণ আইনের ভাষায় সেটিই ‘বারডেন অব প্রুফ’।
কোন মামলায় আদালতে তোলা হলো?
সাবেক মন্ত্রী আনিসুল হককে যাত্রাবাড়ী থানার পৃথক তিনটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তাঁকে সকাল ১০টার পর দুই হাত পেছনে হাতকড়া পরিয়ে হাজতখানা থেকে আদালতে আনা হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে আদালতে তিনটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করা হয় এবং আদালত সেই আবেদনে সম্মতি দেন। মামলাগুলো দণ্ডবিধির ৩০২ (হত্যা), ৩৪ (একাধিক ব্যক্তির সম্মিলিত উদ্দেশ্য) ও ১২০বি (ষড়যন্ত্র) ধারায় করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
একই দিনে আরও কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী ও রাজনীতিককে আদালতে হাজির করা হয়। এদের মধ্যে আছেন আমির হোসেন আমু, শাজাহান খান, জুনাইদ আহমেদ পলক, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব জাহাঙ্গীর আলম।
রিমান্ডে সাবেক সচিব, ফ্যাসিস্ট সহযোগীর তকমা
মেহেদী হাসান হত্যা মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব জাহাঙ্গীর আলমকে দুই দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত। পিপি ওমর ফারুক ফারুকী এ সময় বলেন, “তিনি ফ্যাসিস্ট হাসিনার সহযোগী, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন, পুলিশ ও উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।”
তাঁর আইনজীবী ফারজানা ইয়াসমিন এর বিরোধিতা করে বলেন, ‘জাহাঙ্গীর আলম কেবল একজন সরকারি কর্মচারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর স্বাস্থ্য বর্তমানে খারাপ এবং তিনি তিন সপ্তাহ ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।’ তবে আদালত রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
বিচারক নিয়োগেও দলীয় প্রভাবের অভিযোগ
শুনানির সময় পিপি ফারুকী আরও অভিযোগ করেন, ‘আওয়ামী লীগের আমলে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারকদের ডিএনএ টেস্ট পর্যন্ত করানো হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা বিচারক প্রার্থীদের তথ্য সংগ্রহ করেছেন। যারা আওয়ামী লীগ করত, তাঁদেরই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘শুধু বিচার বিভাগ নয়, পুলিশ ও প্রশাসনেও দলীয় আনুগত্য যাচাই করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যারা ভিন্নমত পোষণ করতেন, তাঁদের খাগড়াছড়ি বা বান্দরবানে পাঠানো হয়েছে, ওএসডি করা হয়েছে বা চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।’
আদালতের পরিবেশ ও মেননের ওষুধ
আদালত উপস্থিত আইনজীবী ও সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘কোনো আইনজীবী অনুমতি ছাড়া আসামিদের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না। সাংবাদিকরাও কথা বলতে পারবেন না।’
এ সময় রাশেদ খান মেনন ওষুধ চাইলে তাঁর আইনজীবী তা আদালতের অনুমতির জন্য উপস্থাপন করেন। বিচারক বলেন, ‘ওষুধ সরবরাহ করতে পারবে কেবল কারা কর্তৃপক্ষ।’ পরে আদালতের আদেশে সংশ্লিষ্ট ওষুধ হস্তান্তরের ব্যবস্থা হয়।
আদালতের হাজতখানায় আনা হয় সাবেক মন্ত্রীদের সবাইকে, হাতকড়া পরিহিত অবস্থায়। শুনানির সময় বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা আমির হোসেন আমু ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছিলেন না। বিচারকের নির্দেশে তাঁকে বসার জন্য একটি টুল দেওয়া হয়।
রাজনৈতিক বিচার নাকি বিচারিক রাজনৈতিকতা?
পিপি ফারুক ফারুকীর বক্তব্য এবং আনিসুল হকসহ সাবেক নেতাদের নিরুত্তর থাকা নিয়ে আইনজীবী ফারজানা ইয়াসমিনকে প্রশ্ন করা হ্য় -এটি কি রাজনৈতিক প্রতিশোধ, না কি পূর্বের অবিচার সামনে আনতে চাওয়া এক বিচারিক প্রয়াস?
আইনজীবী ফারজানা ইয়াসমিন বিষয়টিকে সরাসরি মামলার বাইরের আলোচনার মাধ্যমে আদালতের মনোভাব প্রভাবিত করার চেষ্টা হিসেবে দেখছেন। তাঁর মতে, ‘আদালতে একমাত্র বিচার্য বিষয় হলো মামলার অভিযোগ ও প্রমাণ।’
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment