×

আজাদী! আজাদী! নারীর ডাকে মৈত্রীযাত্রা

মো. ইসতিয়াক 

আজাদী! আজাদী!—এই স্লোগানে মুখর হয়ে উঠেছিল রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ। নারীর অধিকার, মর্যাদা, নিরাপত্তা এবং সম-অধিকারের দাবিতে আজ ১৬ মে শুক্রবার অনুষ্ঠিত হলো ‘নারীর ডাকে মৈত্রীযাত্রা’ কর্মসূচি। আয়োজকদের ভাষ্যে, এই কর্মসূচি শুধু একটি প্রতিবাদ নয়- এটি ছিল নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতিশ্রুতি, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নারীর সম্মিলিত পথচলা।

বেলা দুইটা থেকে শুরু হওয়া এই কর্মসূচিতে অংশ নেন প্রগতিশীল নারী, সাংস্কৃতিক কর্মী, শ্রমিক, শিক্ষার্থী ও পেশাজীবী সংগঠনের হাজারো প্রতিনিধি। ব্যানার-প্ল্যাকার্ড হাতে তাঁরা ভিড় করেন মঞ্চের সামনে। স্লোগানে স্লোগানে তাঁরা জানান দেন, ‘নারীকে বাদ দিয়ে কোনো বিপ্লব নয়, সমতা ছাড়া গণতন্ত্র নয়।’

আন্দোলনের পটভূমি

গত বছরের জুলাইয়ে বাংলাদেশে ঘটে যায় এক নজিরবিহীন গণ-অভ্যুত্থান। আন্দোলনের কেন্দ্রে ছিলেন সাধারণ মানুষ, তার অগ্রভাগে ছিলেন নারীরা। কিন্তু অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে নারীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিসর থেকে একপ্রকার সচেতনভাবেই দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা চলে। আইনশৃঙ্খলার দুর্বলতা এবং পিতৃতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ছত্রছায়ায় নারীরা আবারও সহিংসতা, নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হন।

এই পরিপ্রেক্ষিতেই গড়ে ওঠে ‘নারীর ডাকে মৈত্রীযাত্রা’। আয়োজকদের দাবি, এটি জুলাই-পরবর্তী নারী আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
কর্মসূচির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল একটি ঘোষণাপত্র পাঠ। এতে স্পষ্টভাবে বলা হয়, ‘চব্বিশের অভূতপূর্ব জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে আজ আমরা এক গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি মুহূর্তে ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। আমাদের দাবি একটি গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশ।’

ঘোষণাপত্রের মূল বক্তব্য

ঘোষণাপত্রে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের ৪৩৩টি সুপারিশের কথা উল্লেখ করে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় যে সরকারের পক্ষ থেকেই গঠিত এই কমিশনের সদস্যদের প্রতি এখন চলছে অপপ্রচার ও অপমান। আর সরকার রয়েছে আশ্চর্যরকম নিশ্চুপ।

এ ছাড়াও ঘোষণাপত্রে তুলে ধরা হয়, ‘এখনো এ দেশে কৃষি, মৎস্যজীবী ও গৃহকর্ম পেশায় নারীদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। একই কাজে নারীরা পুরুষের তুলনায় কম মজুরি পান। দলিত, হরিজন ও আদিবাসী নারীরা জাতিগত নিপীড়নের শিকার হন। পার্বত্য চট্টগ্রামে নারীদের ওপর চলে সেনাবাহিনীর অকথ্য নির্যাতন। আজ যখন অধিকারের দাবিতে আমরা সমবেত হয়েছি, তখন বম নারীরা কারাগারে বন্দী। বাংলাদেশের শতকরা ৯৬ ভাগ নারী ভূমির মালিকানা থেকে বঞ্চিত। এশিয়ায় বাল্যবিবাহে শীর্ষে বাংলাদেশ। স্বামী বা সঙ্গীর হাতে নির্যাতনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ। প্রতিনিয়ত নারীরা বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন, অথচ ধর্ষণ, যৌতুক-হত্যা, আত্মহত্যায় প্ররোচনা- এ সব মামলায় ৯৭ শতাংশ ক্ষেত্রেই বিচার হয় না। অভিন্ন পারিবারিক আইন না থাকায় নারীরা অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত হন, যৌনকর্মীরা পান না নাগরিক সুরক্ষা, লিঙ্গ বৈচিত্র্যের মানুষরা পান না স্বীকৃতি, আর প্রবাসী নারী শ্রমিকরা ফিরছেন লাশ হয়ে। এসব কাঠামোগত বৈষম্যের বিরুদ্ধেই আমাদের সংঘবদ্ধ লড়াই, আমাদের লক্ষ্য সাম্য ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা।’

নির্বাচনকে সামনে রেখে ঘোষণাপত্রে বেশ কিছু দাবি উপস্থাপন করা হয়:

১. নারী প্রার্থীর কোটা নিশ্চিত করা: আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের অন্তত ৩৩ শতাংশ নারী হতে হবে- এই দাবিকে ঘোষণাপত্রের কেন্দ্রীয় দাবি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।

২. সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠা: নারী, শ্রমিক, আদিবাসী, ধর্মীয় ও লিঙ্গীয় সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দাবি করা হয় রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে।

৩. সহিংসতা ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা: নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের বিরুদ্ধে চালানো অপপ্রচার ও কমিশনের সদস্যদের অপমানের ঘটনায় সরকারের নীরবতাকে ‘নিন্দনীয়’ বলা হয় এবং দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ দাবি করা হয়।

৪. নারীর ক্ষমতায়ন ও সুরক্ষা: শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

ঘোষণাপত্রে অভিযোগ করা হয়, প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নারীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। নারীদের ব্যক্তিগত আক্রমণ, অনলাইনে হয়রানি, যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ এবং মব হামলার মতো ঘটনা চলছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। এসব ঘটনার বিরুদ্ধে সরকার নীরব ভূমিকা পালন করছে বলেও তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়।

ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়, ‘আমরা চুপ করব না, হুমকির মুখে নত হব না। আমরা আমাদের অধিকার আদায়ের দাবিতে অটল থাকব। ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশের স্বপ্ন ও তা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমরা হাল ছাড়ব না।’

অংশগ্রহণকারী সংগঠন ও সংহতি

এই কর্মসূচিতে সংহতি জানিয়েছে ৫০টির বেশি সংগঠন। এর মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, নারী মুক্তি কেন্দ্র, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, হিল উইমেনস ফেডারেশন, আদিবাসী ইউনিয়ন, গার্মেন্টস শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন, বিজ্ঞান আন্দোলন মঞ্চ, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম, বাংলাদেশ নারী জোট, নারী সংহতি, ছাত্রফ্রন্ট (মার্ক্সবাদী), তীরন্দাজ, শ্রমিক অধিকার আন্দোলন প্রভৃতি।

স্লোগানে প্রতিধ্বনিত হয় প্রতিবাদের ভাষা 

কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আয়োজকেরা ৩১টি স্লোগানের তালিকা প্রকাশ করেন। এসব স্লোগানে উঠে এসেছে- নারীর অধিকার, মর্যাদা, নিরাপত্তা, শ্রমিকের অধিকার, ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা এবং আন্তর্জাতিক সংহতি, বিশেষ করে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থনের বার্তা।

‘নারীর ডাকে মৈত্রীযাত্রা’ কর্মসূচির ঘোষণাপত্রে বলা হয়, ‘আমরা সরকার ও প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নারী বিষয়ক অবস্থান নজরদারিতে রাখব। যে ক্ষমতা কাঠামো এসব জুলুমবাজি জিইয়ে রাখে, আমরা সেই কাঠামোকে ভাঙব।’

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment