×

মাগুরায় শিশু ধর্ষণ ও হত্যা: ১ জনের মৃত্যুদণ্ড, খালাস ৩

মাগুরায় আলোচিত শিশু ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় ঐতিহাসিক এক রায় দিয়েছেন আদালত। মাত্র দুই মাস ১১ দিনে সম্পন্ন হওয়া এই মামলায় প্রধান আসামি হিটু শেখকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। ১৭ মে শনিবার সকালে মাগুরার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল এই রায় প্রদান করেন।

মামলার বাকি তিন আসামি, সজীব শেখ, রাতুল শেখ ও রোকেয়া বেগমকে খালাস দেওয়া হয়েছে। রায়ে সন্তুষ্ট হতে পারেননি শিশুটির মা ও মামলার বাদী আয়েশা বেগম। আদালতের বাইরে উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘হিটু শেখের ফাঁসির আদেশ হয়েছে, এটা কিছুটা ন্যায়বিচার। কিন্তু যারা তাঁকে সহায়তা করেছে, ভয় দেখিয়েছে, প্রমাণ গোপন করেছে- তাদের খালাস মেনে নেওয়া যায় না।’

বলা দরকার, ১ মার্চ মাগুরা সদর উপজেলার নান্দুয়ালী গ্রামে বড় বোনের শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে যায় আট বছর বয়সী শিশুটি। ৫ মার্চ রাতে তাঁর বোনের শ্বশুর হিটু শেখ শিশুটিকে ঘরে একা পেয়ে ধর্ষণ করে এবং হত্যাচেষ্টা চালায়।

গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে মাগুরা সদর হাসপাতাল এবং পরে ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়। আট দিন পর ১৩ মার্চ সেখানেই মারা যায় শিশুটি।

মামলা ও বিচারপ্রক্রিয়ার গতিপথ

২০২৫ সালের ৮ মার্চ শিশুটির মা আয়েশা বেগম বাদী হয়ে মাগুরা সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় আসামি করা হয় চারজনকে, হিটু শেখ (প্রধান আসামি), সজীব শেখ (শিশুটির বোনের জামাতা), রাতুল শেখ (সজীবের ভাই) ও রোকেয়া বেগম (হিটু শেখের স্ত্রী)।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আলাউদ্দিন ১৩ এপ্রিল অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে বলা হয়, হিটু শেখ ধর্ষণ ও হত্যার প্রধান আসামি, সজীব শেখ খুনের ভয়ভীতি প্রদর্শনে সহায়তাকারী, রাতুল শেখ ঘটনার সহায়তাকারী ও রোকেয়া বেগম তথ্য গোপন ও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন।

২৩ এপ্রিল আদালত অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর দিন ধার্য করেন। ২৭ এপ্রিল সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয় এবং টানা ১২ কার্যদিবস শুনানি চলার পর ১৭ মে রায় ঘোষণা করা হয়।

কোন আইনে দণ্ড ও খালাস

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ধারা ৯(১) অনুযায়ী হিটু শেখকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এই ধারায় বলা হয়েছে, কোনো শিশু বা নারীর ধর্ষণের ফলে মৃত্যু হলে অভিযুক্তের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

অন্যদিকে অপর তিন আসামির বিরুদ্ধে একই আইনের ধারা ৯(৪) ও ধারা ১১(গ)তে সহায়তা ও প্ররোচনার অভিযোগ এবং তথ্য গোপন ও সাক্ষ্যপ্রমাণ নষ্ট করার অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু আদালত পর্যবেক্ষণে বলেন, ওই তিন আসামির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি।  

সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মনিরুল ইসলাম মুকুল বলেন, ‘বাদী পক্ষ রায়ে অসন্তুষ্ট। আমরা আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেব উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে কি না।’

দ্রুত বিচার একটি দৃষ্টান্ত হলেও প্রশ্ন রয়ে যায়

মাত্র ৭০ দিনের ব্যবধানে অভিযোগ গঠন, সাক্ষ্যগ্রহণ ও রায় প্রদান- বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় এটি বিরল। দ্রুত বিচারকে আদর্শ মনে করলেও অনেকে প্রমাণের ঘাটতি ও তদন্তের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন ‘মানববন্ধন মাগুরা’র আহ্বায়ক স্ট্রিমকে বলেন, ‘তিন আসামির খালাস মানে প্রক্রিয়ায় হয়তো ঘাটতি ছিল, অথবা তদন্ত পর্যাপ্ত হয়নি। পুনর্বিবেচনা হওয়া উচিত।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জাহিদুল ইসলাম বিশ্বাস স্ট্রিমকে বলেন, ‘মাগুরার এই ঘটনা শুধু একটি বিচার নয়, এটি রাষ্ট্র ও সমাজের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। এক শিশুর করুণ মৃত্যু, ন্যায়বিচারের লড়াই এবং আইনের কাঠামোয় দেওয়া রায়- সবকিছু মিলিয়ে এটি এক যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত।’

তবে সেইসাথে তিনি এই প্রশ্নও করেন, ‘আসামিদের সম্পূর্ণ বিচার হলো কি? নাকি শিশুটির পরিবারকে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে ন্যায়বিচারের পূর্ণতা পেতে?’ 

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment