জগন্নাথের ১৭ বছরের আন্দোলন: আশ্বাস, আশ্বাস আর আশ্বাস…
শতাব্দীকা ঊর্মি
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা তিনটি দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলেন। তাঁদের দাবি ছিল- বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট বাড়ানো, শিক্ষার্থীদের আবাসনের ব্যবস্থা ও দ্বিতীয় ক্যাম্পাস নির্মাণের কাজ শুরু করা।
১৩ মে ইউজিসিতে (বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন) গিয়ে দাবিগুলো জানান তাঁরা। কিন্তু কোনো সুনির্দিষ্ট আশ্বাস না পেয়ে পরদিন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় অভিমুখে ‘লং মার্চ টু যমুনা’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
লং মার্চে পুলিশ বাধা দেয়। শিক্ষার্থীরা ব্যারিকেড ভাঙতে গেলে শুরু হয় সংঘর্ষ। আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড ও জলকামান ব্যবহার করে। এতে অর্ধশতাধিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী আহত হন।
পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে শিক্ষার্থীরা কাকরাইলে অবস্থান নেয়। ১৪ মে বুধবার রাত ১০টার দিকে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ঘটনাস্থলে যান। তাঁকে দেখে শিক্ষার্থীরা ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দেন। এক শিক্ষার্থী তাঁর দিকে পানির বোতল ছুড়ে মারে। কিছুটা উত্তপ্ত হয় পরিস্থিতি।
পরদিন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন সংগঠন জানায়- দাবি না মানা পর্যন্ত তাঁদের অবস্থান চলবে। ১৬ মে শুক্রবার সমাবেশ হয় তিনদফা দাবিতে। পরে সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস এলে আন্দোলন কিছুদিনের জন্য স্থগিত করা হয়। তবে শিক্ষার্থীরা জানিয়ে দেয়, দাবি না মানলে তাঁরা আবারও আন্দোলনে নামবেন।
এর আগেও এমন আশ্বাস পাওয়া গেছে। গত বছর যখন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা একই দাবিতে আন্দোলন ও পরে অনশন নেমেছিল, তখন সেনাবাহিনীর হাতে দ্বিতীয় ক্যাম্পাস নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়ার আশ্বাসে অনশন থামানো হয়েছিল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। শুধু আশ্বাসই পাওয়া গেছে বারবার।
এ বিষয়ে নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী তাকরিম বলেন, ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিগুলো নতুন নয়। কোনো সরকারের আমলেই আমরা ন্যায্য অধিকার পাইনি। আমরা ভেবেছিলাম এবার কিছু হবে, কিন্তু হয়নি। সবসময় শুধু মেয়াদোত্তীর্ণ আশ্বাস পাই।’
হল আন্দোলন : আশ্বাসের পুনরাবৃত্তি
১৮৫৮ সালে ব্রাহ্ম স্কুল হিসেবে যাত্রা শুরু করে এই প্রতিষ্ঠান। ১৮৭২ সালে মানিকগঞ্জের জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরী তার বাবার নামে একটি স্কুলের নাম রাখেন ‘জগন্নাথ স্কুল’। এরপর সময়ের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি বড় হতে থাকে। ১৮৮৪ সালের ৪ জুলাই এটি একটি দ্বিতীয় শ্রেণির উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে পরিণত হয়। পরবর্তীতে ১৯০৮ সালে এটি প্রথম শ্রেণির স্নাতক কলেজে রূপ নেয়। ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠানটি পরিণত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে।
তারও অনেক আগে, ১৯৮৬ সালে এই প্রতিষ্ঠানের ১১টি হল দখলে চলে যায়। এরপর থেকে শিক্ষার্থীরা বারবার আন্দোলন করেছে আবাসনের জন্য। প্রতিবার একই চিত্র- আন্দোলন হয়, আশ্বাস আসে, কাজ হয় না। অনেকেই বলছে, ‘যত আন্দোলন, তত মুলা’। এই প্রবাদ এখন বাস্তবে রূপ নিয়েছে জগন্নাথে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস গৌরবময়। এখান থেকে পাস করেছেন ভাষা আন্দোলনের শহীদ রফিক ও মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ। তবু আজও শিক্ষার্থীদের ভাত, চেয়ার-টেবিল, ওজন মাপা যন্ত্রের জন্য আন্দোলন করতে হয়।
২০১৪ সালে ‘হল উদ্ধার’ আন্দোলনে পুলিশ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে। তখন একটি তদন্ত কমিটি হয়, কিন্তু কাজ হয়নি। ২০১৬ সালে আবার আন্দোলন শুরু হয়। তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেরানীগঞ্জে নতুন ক্যাম্পাসের ঘোষণা দেন। ঘোষণা অনুযায়ী ২০০ একর জমি নির্ধারণ করা হয়।
তবে আজও সেখানে কাজ দৃশ্যমান হয়নি। নেই সীমানা দেয়াল, নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা। নির্মাণ স্থানে রড-সিমেন্ট চুরিও হয়েছে একাধিকবার। কাজের অগ্রগতি নেই বললেই চলে।
একবার সাবেক উপাচার্য মিজানুর রহমান ২ হাজার কোটি টাকার প্রতীকী চেক ক্যান্টিনে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। কোনো বাস্তব কাজ না করেই সেটি প্রদর্শন করা হয়। তাতে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ আরও বাড়ে।
২০১৯ সালের আন্দোলনে ছাত্রী হল নির্মাণ করা হয় এবং আবারও দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের আশ্বাস আসে। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি। ২০২৪ সালে ফের আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। শ্লোগান ওঠে- ‘সব শালারা বাটপার, আর্মি হবে ঠিকাদার।’ তখন শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, ‘আন্দোলনের দরকার ছিল না।’ কিন্তু শিক্ষার্থীরা আবারও দেখছে- কাজ হচ্ছে না, কেবল কথা হচ্ছে।
২০২৫ সালের শুরুতে আবার আমরণ অনশন শুরু হয়। শিক্ষার্থীরা সচিবালয়ের সামনে অবস্থান নেয়। অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ে। আবার দেওয়া হয় আশ্বাস।
সাবেক শিক্ষার্থী সাজ্জাদ হুসাইন মুন্না বলেন, ‘আমরা অনেকবার আন্দোলন করেছি। হামলা-নির্যাতনের মুখেও দাঁড়িয়েছি। তবু জবির (জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের) সমস্যার সমাধান হয়নি। এবার আশ্বাস নয়, বাস্তব পদক্ষেপ চাই।’
এখন প্রশ্ন- একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যদি ভাত, চেয়ার বা চিকিৎসা সেবার জন্য আন্দোলন করতে হয়, তাহলে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা আসলে কেমন?
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment