আতঙ্ক কাটেনি মতুয়া সম্প্রদায়ের, এখানো খোলা আকাশের নিচে পরিবার
স্ট্রিম প্রতিবেদক
যশোরের অভয়নগরে মতুয়া সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা করে লুটপাট ও অগ্নিকাণ্ডের পর তিন দিন পেরিয়ে গেছে। এখনো কেউ পোড়া ভিটায় ঘর তুলতে পারিনি, রান্নাবান্নাও করা হচ্ছে না। আশপাশের লোকজনের দেওয়া খাবার খাচ্ছেন তাঁরা। দুর্বৃত্তদের হামলার মুখে গ্রাম ছেড়ে যাওয়া যাওয়া পুরুষদের মধ্যে মাত্র দুজন এলাকায় ফিরেছেন।
ভবদহ অঞ্চলের বিলের মধ্যে বাড়েদা পাড়ার অবস্থান। দুর্বৃত্তের দেওয়া অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে পাড়াটিতে বিদ্যুৎ নেই। রান্নার জন্য কোনো বাড়ির চুলায় জ্বলেনি রবিবার (২৫ মে) পর্যন্ত। নিরাপত্তা দিতে মোড়ে মোড়ে মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ। মাঝেমধ্যে আসছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরাও। তারপরও আতঙ্ক কাটেনি মতুয়া সম্প্রদায়ের এই পাড়াটিতে। শনিবার (২৪ মে) পর্যন্ত জেলা প্রশাসন থেকে এ সব পরিবার প্রতি কিছু চাল-ডাল, দুই বান ঢেউটিন সহায়তা করা হয়েছে বলে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
এর আগে বৃহস্পতিবার (২২ মে) উপজেলার নওয়াপাড়া পৌর কৃষক দলের সভাপতি তরিকুল ইসলাম সরদার হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এর জের উপজেলার ডহরমশিয়াহাটির বাড়েদাপাড়ার ১৪ পরিবারের ২০টি বাড়ির আগুন দিলে পুড়ে গেছে সর্বস্ব। অগ্নিসংযোগের আগে এসব বাড়িতে লুটপাট করা হয়েছে।
বিএনপির দুঃখপ্রকাশ
অগ্নিকাণ্ড ও লুটপাটের ঘটনায় শনিবার বাড়েদাপাড়ার পরিদর্শন করেন জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেরুল হক সাবু, সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন খোকন, উপজেলা বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান নার্গিস বেগম, সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিতসহ দলীয় নেতা-কর্মীরা। এ সময় নেতারা ওই ঘটনার জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন এবং জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তাঁরা।

এখনো খোলা আকাশের নিচে
বাড়েদাপাড়ায় দোচালা টিনের বাড়িতে ছেলেকে নিয়ে বসাবস করতেন মহিতুল বিশ্বাস ও স্মৃতি বিশ্বাস দম্পতি। হামলা ও লুটপাটের সময় পরিবারের দুই পুরুষ সদস্য সরে গেলে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এখন মাথার গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে উঠানের এক কোণে খোলা আকাশের নিচে তিন দিন রয়েছেন।
স্মৃতি বিশ্বাস বলেন, ‘তিন দিন ধরে আমার বাড়িতে পূজা চলছিল। বিভিন্ন গায়ক দল তাদের কীর্তন করছিল। বিভিন্ন বাজনা বাজছিল। হঠাৎ ৬-৭ জন আমার বাড়িতে এসে কিছু না বলেই ভাঙচুর শুরু করে। আমাকেও মারধর করেছে। তাদের হাতে অস্ত্র ছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘আগুন ধরাতে শুরু করতেই ভগবানের নাম নিতি নিতি প্রাণে বাঁচতে দৌড় দিলাম বিলের দিকে। বনজঙ্গল পানি মাড়িয়ে বিলের এক ঢিবেতে লুকিয়ে থাকলাম। দূর থেকে দেখছি আমার বাড়িঘর আগুনে পুড়ছে। ফিরে এসে দেখি কিচ্ছু নেই।’
আগুনে স্মৃতি বিশ্বাসের বাড়ির টিনের বসতঘর, গোয়ালঘর, দুটো মোটরসাইকেল, কাপড়-চোপড় পুড়ে গেছে। আগুন দেওয়ার আগে তারা বাড়িঘর লুটপাট করেছে হামলাকারীরা।
ঘটনার দিন প্রথমে আগুন দেওয়া হয় পরিতোষের বাড়িতে। তিনি বলেন, ‘কোন রকম জানডা নিয়ে পালিয়ে ছিলাম। জামা-গেঞ্জি পড়ার সময়টুকুও পায়নি। বাড়িতে বুড়ো মা-বাবা ছিলো, তাদের ফেলে চলে গেছিলাম। আগুন দিলে ফায়ার সার্ভিসের লোকদের জানানো হয়। কিন্তু হামলাকারীরা তাদের আসতে দেয়নি।’
ঘটনা যেভাবে শুরু
উপজেলার নওয়াপাড়া পৌর কৃষক দলের সভাপতি তরিকুল ইসলাম সরদার। ঘের লিজ নেওয়ার জন্য বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ডহরমশিয়াহাটির বাড়েদাপাড়াতে পিন্টু বিশ্বাসের বাড়ি যান তিনি। সেখানে চুক্তিপত্র করা নিয়ে উত্তেজনার কোনো এক সময় অজ্ঞাত সাত-আট সেখানে পৌঁছে। দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে ও পরে গুলি করে তরিকুলকে হত্যা করে পালিয়ে যায়। এ ঘটনার পর তরিকুলের সমর্থকরা পিন্টু বিশ্বাসের তিনটি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, অজ্ঞাত লোকজন দল বেঁধে এসে পিন্টু বিশ্বাসের প্রতিবেশীদের বাড়িতেও ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। ভয়ে তারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আশ্রয় নেয় বিলে ও ঝোপ ঝাড়ে। এরপর দূর থেকে দেখতে পান তাঁদের বাড়ি ঘরে আগুন জ্বলছে। বাড়ি ফিরে দেখেন সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
কী বলছে প্রশাসন
অভয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল আলীম জানান, তরিকুল হত্যাকে কেন্দ্র করে কিছু বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার রাতেই পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা আগুন নিয়ন্ত্রণ করে। বর্তমানে ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
ওসি আব্দুল আলীম আরও বলেন, ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে। এ ঘটনায় প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দুজনকে আটক করা হয়েছে। আর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি। তবে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment