যে পার্ক ধরে আছে দ্রোহের ইতিহাস
পুরান ঢাকার বাহদুরশাহ পার্কটি ব্রিটিশ আমলে প্রথমে ‘আন্টাঘর’ নামে পরিচিত ছিল। পরে রানী ভিক্টোরিয়ার এর এর নাম হয় ভিক্টোরিয়া পার্ক। তবে শেষপর্যন্ত কেন এর নাম ‘বাহাদুরশাহ পার্ক’ হয়েছিল? ইতিহাস ঘেঁটে এবং বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে জানাচ্ছেন শতাব্দীকা ঊর্মি
দুপুরে গনগনে রোদে সদরঘাট এলাকার একখণ্ড ছায়ার আশ্রয় পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক। অনেকের কাছে এটা ভিক্টোরিয়া পার্ক হিসেবে পরিচিত। সারা দিনই এখানে লোকসমাগম থাকে। সকাল-বিকাল হাঁটতে আসেন এলাকাবাসী। এর পাশেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজসহ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে এখানে ঘুরতে আসা মানুষজনেরা তাঁরা এই পার্কের ইতিহাস কতটুকু জানেন?
পার্কে গিয়ে দেখা মিলল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী ছাত্রী অয়ন্তী বিশ্বাস ও মেহেদী হাসানের। পার্কের ইতিহাস নিয়ে জিজ্ঞেস করতেই অয়ন্তী বলেন, ‘আমি এই পার্কের ইতিহাস জানি। ১৮৫৭ সালে দিল্লিতে স্বাধীনতার জন্য সিপাহিরা যখন যুদ্ধ করেছিল, এখন এখানকার সিপাহিরাও যুদ্ধ করেন। তার সাক্ষী এই পার্ক। কিন্তু ইদানীং পার্কে এসে স্বস্তিমতো সময় কাটাতে পারি না। নানান মানুষ ও তাদের অশোভন আচরণ বেশ অস্বস্তি দেয়।’
আজকের বাহদুরশাহ পার্কটি ঔপনিবেশিক আমলে প্রথমে ‘আন্টাঘর’ নামে পরিচিত ছিল। এই নামের পেছনেও রয়েছে একটি ইতিহাস। আঠারো শতকের শেষে দিকে এখানে ছিল ঢাকার আর্মেনীয়দের বিলিয়ার্ড ক্লাব। সে সময় বিলিয়ার্ড বলকে স্থানীয়রা ডাকতেন ‘আন্টা’। এখানে থেকেই এসেছে আন্টাঘর নামটি। পরে রানী ভিক্টোরিয়ার সময় তাঁর নামানুসারে এর নাম হয় ভিক্টোরিয়া পার্ক। তারপর সিপাহি অভ্যুত্থানের স্মরণে এটি ‘বাহাদুরশাহ পার্ক’ নামে পরিচিতি পায়।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮৫৭ সালে শেষ মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে সামনে রেখে সিপাহি যুদ্ধ ব্রিটিশ-ভারতে স্বাধীনতাসংগ্রামে নতুন অধ্যায় তৈরি করে। দার্শনিক কার্ল মার্কস একে বর্ণনা করেছেন ভারতে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবে। ওই বছর ২২ নভেম্বর ব্রিটিশ মেরিন সেনারা স্বাধীনতাকামী সিপাহিদের আক্রমণ করে। পরাজিত সিপাহিদের আটক করা হয়, ঘোষণা করা হয় মৃত্যুদণ্ড। পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার মোড়ে তৎকালীন আন্টাঘর ক্লাব মাঠে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয় তাঁদের। এমনকি কয়েকদিন পর্যন্ত গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখা হয় মরদেহ।
এদিকে ১৮৭৬ সালে রানী আলেক্সান্দ্রিনা ভিক্টোরিয়া ভারতবর্ষের শাসন শুরু করেন। আন্টাঘর ক্লাব মাঠ থেকেই এলাকাবাসীকে জানানো হয় সেই ঘোষণা। এরপর ক্লাব মাঠ পরিচিত হয় ভিক্টোরিয়া পার্ক নামে। তবে ১৯৫৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষপূর্তিতে জায়গাটির নাম ‘বাহাদুরশাহ পার্ক’ করা হয়। সেই সময় সিপাহিদের আত্মদানের স্মরণে ফাঁসির মঞ্চটিকে স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে পুনর্নিমাণ করা হয়। পার্কে ঢুকলে স্তম্ভটি যেন ইতিহাসের সেই করুণ ও নির্মম হত্যাকাণ্ডের ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
পার্কের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জবি শিক্ষার্থী মেহেদী বলেন, ‘কয়েকদিন আগে সন্ধ্যার পর টিউশন শেষ করে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম পার্কে। কিছুক্ষণ পর দেখলাম একদল স্কুল-কলেজপড়ুয়া ছেলে এসে ধূমপান করছে আর চিৎকার করে কথা বলছে। আর চারদিক থেকে একের পর এক হকার ঢুকছে। তাই এখানে বসা তো দায়। এসব দেখেই উঠে চলে গেলাম।’
ঐতিহাসিক স্থান হলেও বাহাদুর শাহ পার্কের নেই তেমন রক্ষণাবেক্ষণ। এখন নানা জায়গা দখল করে বসে পথখাবারের দোকান ও ফেরিওয়ালা। কিছুদিন পরপর পার্কের আশপাশ পরিস্কার করা হলেও তা আবারও ভরে ওঠে আবর্জনায়।
পার্কের কাঠগোলাপ গাছের নিচে বসে ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব নাসিমা বেগম। ভাই এলেই রওনা দেবেন সদরঘাট লঞ্চঘাটের উদ্দেশ্যে, গন্তব্য বরিশাল। কথা হলে তিনি বলেন, ‘ঢাহায় ভাইয়ের বাসাত আইলে মুই এহেনে (পার্ক) বই।’ তবে পার্কে ইতিহাস সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না।
বাহাদুরশাহ পার্ক একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। তবে এর ঐতিহাসিক গুরুত্বের চেয়ে এলাকাবাসীর অবসর কাটানোর অন্যতম স্থান হয়ে উঠেছে পার্কটি। ইতিহাস বহন করে চলা স্থানটি বীর সিপাহিদের স্মৃতি ও ব্যস্ত মানুষদের একটুখানি অবসরযাপনের আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে প্রতিদিন। কিন্তু তাঁদের অনেকেই হয়তো জানেন না, এই পার্ক ধরে আছে আমাদের দ্রোহের ইতিহাস।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment