শখের শাড়ির দাম কি আসলেই ৩০০ টাকা
৩০০ টাকায় মিলছে শাড়ি! সোশাল মিডিয়ায় এ নিয়ে চলল বেশ হৈচৈ! ঘটনা কি আসলে? সরেজমিন ঘুরে জানাচ্ছেন শতাব্দীকা ঊর্মি
হ্যাঁ ঠিকই পড়ছেন- ৩০০ টাকার এক সাধারণ শাড়ি! যেটার ছবি ছুঁয়ে গেছে হাজারো মানুষের হৃদয়। শাড়ি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে কন্টেন্ট ক্রিয়েটর ও ইনফ্লুয়েন্সার সুনেরাহ তাসনিম। তবে কোনো ঝলমলে ডিজাইনার আউটফিট বা ব্যয়বহুল ব্র্যান্ডের জন্য নয়, বরং মাত্র ৩০০ টাকার এক শাড়ির জন্য!
নিত্যদিনের পোশাক হিসেবে শাড়ি পরতে চান অনেকেই। তবে দাম দেখলেই মাথায় হাত! যদিও গ্রামে এখনো ৩০০-৪০০ টাকায় ছাপা শাড়ির দেখা মেলে, কিন্তু নাগরিক জীবনে তা হাতের নাগালে থাকে না। তবে কী উপায়? কেমন হয় যদি সুনেহরার মতো সবাই খুঁজে পান সস্তায় শখের শাড়ি!

সত্যিই কি পাওয়া যায় ৩০০ টাকার শাড়ি
শুক্রবার বিকেলে শাড়ি পরে ছবি তুলবে নীলিমা। আলমারি হাতড়ে খুঁজে পাওয়া গেল না কোনো প্রিয় শাড়ি। সবই পুরনো যেন। বহুদিন বাদে শাড়ি পরবে, একটি সুন্দর শাড়ি না থাকলে কী হয়! এদিকে শাড়ি কেনার বাজেটও নেই। বান্ধবী রিমার কাছে থেকে শাড়ি চাইতেই সে বলল, ‘৩০০ টাকা নে, আর চল! মতিঝিল থেকে একটা শাড়ি কিনি!’
নীলিমার সঙ্গে শুক্রবারের জমজমাট মতিঝিল হলিডে মার্কেটে ঘুরতে ঘুরতে দেখা মিলল ৩০০ টাকা দামের শাড়ির। শাড়ির দাম নিয়ে তরুণ বিক্রেতা ইসমাইল বললেন, ‘শাড়িডি আমরা আনি কারখানা থেইকা। দোকান খরচ লাগে না এহানে, তাই কমেই ছাইড়া দেই। লাভ কম হয়, বেচি বেশি। ম্যালা আপায় ৪-৫ডা করা লইয়া যায়।’ এই দোকানেই শাড়ি কিনছিলেন কর্মজীবী নারী ত্রিশোর্ধ্ব সাবিহা সুলতানা। শাড়ির মান নিয়ে তিনি জানান, কাপড়ের মান খুব ভালো নয় তবে ঘুরেফিরে কয়েকবার তো পরাই যায়। ৩০০ টাকার শাড়ি তো কয়েক বছর টিকবে না। তাদের ডিজাইনগুলোও সুন্দর।
কেমন ছিল শাড়ির অতীত
বাঙালি নারীর ছবি চিন্তা করলেই মনে ভেসে ওঠে গায়ে শাড়ি জড়ানো কোনো নারী। একটুকরো কাপড়, যার ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে হাজার বছরের ইতিহাস। শাড়ির ইতিহাস প্রাচীন সভ্যতার সমান পুরোনো। খ্রিস্টপূর্ব ৩ হাজার বছর আগে সিন্ধু সভ্যতার উপত্যকায় (বর্তমান পাকিস্তান ও ভারতের অংশ) নারী-পুরুষ উভয়ই গায়ে কাপড় জড়িয়ে রাখতেন। মৌর্য ও গুপ্তযুগে শাড়ির ভঙ্গি হয়ে ওঠে আরও শৈল্পিক। এরপর থেকে নানা সময়ে উপমহাদেশে শাড়ির ধরন ও শৈলীতে এসেছে নানা পরিবর্তনে। অঞ্চলভেদেও আছে পরার কায়দা ও ধরনের বৈচিত্র্য। ১৮ শতকের চিত্রশিল্পী রাজা রবি বর্মা, ভারতের নিজস্ব কাহিনিগুলোকে কল্পনার রঙ্গে চিত্রিত করতেন। সব চরিত্রের পোশাক হিসেবে ব্যবহার করতেন শাড়িকে। অর্থ্যাৎ জীবন থেকে শিল্প–সব জায়গায় আছে শাড়ির উপস্থিতি।

ফ্যাশন স্টেটমেন্টে শাড়ির শিল্প
রোজকার ব্যস্ত জীবনে পছন্দমতো পোশাক পরে থাকেন নারীরা। আধুনিক নারীর গ্ল্যামারে শাড়ির মতো অনন্য আর কীই-বা আছে! জয়পুরের রাজমাতা মহারানি গায়ত্রী দেবীর শাড়ি পরার ঢং আজও আধুনিক নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত স্টাইল। অনুরাগ বসুর সিনেমায় শাড়িতে শ্রুতি (ইলিয়ানা ডি’ক্রুজ) মোহনীয় রূপ, ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘চোখের বালি’তে বিনোদিনী (ঐশ্বর্য রায়), আশালতার (রাইমা সেন) কিংবা সত্যজিতের সিনেমার চারুলতার দোল খাওয়ার দৃশ্য–সব জায়গায় শাড়ি হয়ে আছে জীবন্ত শিল্প। এমনকি ২৭ বছর আগের ‘দেবদাস’ সিনেমার পার্বতীকে (ঐশ্বর্য রায়) মনে করলে ভাসে তার শাড়ি পরা আইকনিক ছবি। মহানায়িকা সুচিত্রা সেন থেকে আরতি মজুমদার বা আধুনিক বাংলা সিনেমার অনেক অভিনেত্রী শাড়িতে ছড়াতেন দ্যুতি। হাল-আমলের অভিনেত্রী বাঁধন ‘কান চলচ্চিত্র উৎসব ২০২১’-এর মঞ্চে হেঁটেছেন জামদানি শাড়িতেই।
৩০০ টাকার শাড়ি কি আমাদের ‘মিনিমালিজম’ শেখায়?
সাবিহা সুলতানার পাশে ছিলেন ছোট বোন রিনি। অনার্স-পড়ুয়া রিনি বলছিলেন, ‘শাড়ির ব্যাপারে আমি মিনিম্যালিস্ট’। অত চকমকে শাড়ি আমার ঠিক ভালো লাগে না।’ ভোগবিলাসের এ দুনিয়ায় রিনির মতো অনেকেই চান মিনিম্যালিস্ট জীবন। মিনিমালিজম বা স্বল্পবাদ ১৯ শতকে চিত্রশিল্পে থেকে শুরু হওয়া এক মতবাদ। তবে বর্তমানে এটা জীবনযাপনেরও এক স্টাইল। মিনিমালিজম আমাদের শেখায় কী দরকারি আর কী দরকারি না, তা সচেতনভাবে বেছে নেওয়ার শিল্প। ফাস্ট ফ্যাশন বা সুলভ মূল্যে ট্রেন্ডি কাপড়ের জমজমাট সময়ে ৩০০ টাকার শাড়িগুলো যেন আলাদিনের চেরাগ। এ নিয়ে রিনি আরও জানান, ‘আজকের দিনে ফাস্ট ফ্যাশনের ট্রেন্ড যখন আমাদের অপ্রয়োজনীয় ভোগের দিকে ঠেলে দেয়, তখন ৩০০ টাকার শাড়ি আমাদের দেখায় সীমার মধ্যে অসীম সৌন্দর্য।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment