প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ৮ দলের বৈঠক: সুষ্ঠু নির্বাচন ও জাতীয় ঐক্যের প্রতি জোর
স্ট্রিম ডেস্ক
বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন ও রাজনৈতিক সংকট সমাধানের উদ্দেশ্যে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আটটি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতারা বৈঠক করেছেন। সভায় গণসংহতি আন্দোলন, নাগরিক ঐক্য, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, গণ অধিকার পরিষদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের পার্টি (এবি পার্টি), কমিউনিস্ট পার্টি এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। তারা নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময়সূচি, বিচার, সংস্কার, করিডর-বন্দর উন্নয়ন ও রাজনৈতিক ঐক্য বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এই আলোচনায় সুষ্ঠু ও সময়মতো জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রয়োজনীয়তা সর্বোচ্চ প্রাধান্য পায়।
২৫ মে সন্ধ্যা সাতটা থেকে প্রধান উপদেষ্টা এই আট দলের নেতাদের সঙ্গে দুই পর্বে আলোচনায় বসেন।
সংস্কারের অগ্রগতি ও রাজনৈতিক ঐক্যে অংশগ্রহণের আহ্বান: মাহমুদুর রহমান মান্না
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে জানান, প্রধান উপদেষ্টার মনে হয়েছিল তাঁর কাজ ব্যর্থ হবে যদি সব রাজনৈতিক দল সমর্থন না দেয়। তাই তাঁরা তাকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বেশি আলাপ-আলোচনা করার পরামর্শ দিয়েছেন এবং নির্বাচন প্রক্রিয়া সবার সঙ্গে শেয়ার করার কথা বলেছেন। মান্না আরও বলেন, কোন সংস্কার অবিলম্বে করতে হবে। কারণ, দেরি হলে নির্বাচনও দেরিতে হবে। তবে প্রধান উপদেষ্টা আশ্বস্ত করেছেন, এপ্রিলের পর আর সময় গড়াবে না এবং ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চান না।
অন্যদিকে, কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, জুলাই আন্দোলনের স্পিরিট নস্যাৎ করার চেষ্টা চলছে এবং রাজনৈতিক ঐক্য মানে ইউনিফর্ম নয়, বরং জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সংস্কারকেই আসল সংস্কার বলা যায়। এ ছাড়া, যেসব সংস্কার করা যাবে না সেই ধারণা থেকে দূরে থাকতে হবে।

নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে আলোচনা জোনায়েদ সাকির
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেছেন, সরকার ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা ঘোষণা করলেও কোনো নির্দিষ্ট তারিখ না দেয়ায় রাজনৈতিক দলগুলো প্রস্তুতি নিতে পারছে না এবং বিনিয়োগের পরিকল্পনাও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি জানান, নির্বাচন পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যখন পূর্ণভাবে কাজ শুরু করবে, তখনই তারা নির্বাচন সময়সূচি নির্ধারণ করবে। প্রশাসন গোছানোর পর নির্বাচন নিয়ে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হবে। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি জনগণের আস্থা উল্লেখ করে সাকি বলেন, তাঁকে এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং সরকারের উচিত একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করা, যাতে তা বাংলাদেশের ইতিহাসে অনুপ্রেরণার উৎস হয়।
জুলাই মাসের অভ্যুত্থান প্রসঙ্গে সাকি সতর্ক করে বলেন, একদল যেন এককভাবে ওই ঘটনার কৃতিত্ব দাবি না করে, কারণ এটি সবার সম্মিলিত অবদানের ফল। নির্বাচনের বিষয়টি বিলম্বিত হওয়ার অভিযোগ সরকার মানছে না বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সাকি মনে করেন, বাংলাদেশ বর্তমানে জাতীয় পুনর্গঠনের পর্যায়ে রয়েছে এবং এ মুহূর্তে জাতীয় নির্বাচনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য একটি স্পষ্ট রোডম্যাপ থাকা দরকার, যদিও স্থানীয় নির্বাচন কিছু সময়ের জন্য পিছিয়ে গেলেও তা বড় সমস্যা নয়।
জাতীয় অস্থিতিশীলতা মোকাবিলায় ধৈর্য ও প্রজ্ঞার আহ্বান জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতের পর বলেন, জাতির সংকটকালে তাঁরা চলমান পরিস্থিতি নিয়ে অন্তরঙ্গ ও খোলামেলা আলোচনা করেছেন। আলোচনায় সংস্কার, বিচার, নির্বাচন, চট্টগ্রাম বন্দর ও করিডর উন্নয়ন, হেফাজতের মামলা প্রত্যাহার এবং নারী সংস্কার কমিশনের বিষয়গুলো উঠে এসেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হওয়ায় ইসলামী বোধ-বিশ্বাসবিরোধী কার্যক্রম বন্ধ ও আগ্রাসী মনোভাবের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।
দুই ছাত্র উপদেষ্টার অপসারণ বা পদত্যাগ দাবি গণ অধিকার পরিষদের
গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর জানান, দুই ছাত্র উপদেষ্টার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠায় তাঁদের অপসারণ অথবা পদত্যাগের বিষয়টি প্রধান উপদেষ্টার কাছে নিয়ে গিয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়ার দাবি করা হয়েছে। তিনি জানান, অনেক উপদেষ্টার পারফরম্যান্স ও বিভিন্ন মন্তব্য সম্পর্কে ড. ইউনূস অবগত আছেন, তবে এ নিয়ে এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। বৈঠকে ঢাকার দুই সিটির চলমান অচলাবস্থা নিয়ে আলোচনা হয় এবং সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সরকারের ভালো সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়। নুরুল হক নুর বলেন, রাষ্ট্রের বন্দরসহ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে যেন সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সেটিও প্রধান উপদেষ্টাকে উল্লেখ করা হয়েছে।
করিডর, বন্দর ও হেফাজতের মামলায় প্রধান উপদেষ্টার তদারকি চান মামুনুল হক
যমুনায় বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে মামুনুল হক বলেন, প্রধান উপদেষ্টা সবার সহযোগিতায় একটি সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে চান। নির্বাচনের আগে গণহত্যাকারীদের বিচার প্রক্রিয়ার অগ্রগতি ও কয়েকটি মামলার রায় কার্যকর করার দাবিও জানানো হয়েছে। এ ছাড়া করিডর, বন্দরসহ দেশের স্বার্থবিরোধী কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে না এবং হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে চলমান মামলাগুলো প্রধান উপদেষ্টার তদারকিতে থাকবে। নারী সংস্কার কমিশনের বিষয়েও ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন, পাশাপাশি ইসলামবিরোধী কোনো ধারা থাকবে না বলে আশ্বাস দিয়েছেন।

প্রধান উপদেষ্টাকে মাঝপথে না যাওয়ার অনুরোধ চরমোনাই পীরের
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম প্রধান উপদেষ্টাকে মাঝপথে পদত্যাগ না করার অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে অনেক মা তাঁদের সন্তান হারিয়েছেন এবং অনেকে পঙ্গু হয়েছেন, তাই প্রধান উপদেষ্টাকে দেশের জন্য দায়িত্ব পালন করতে হবে।
রোডম্যাপ ও সমন্বয়ের দাবি বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের স্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। তিনি সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতার উদ্বেগ প্রকাশ করেন । তিনি করিডোর ও বন্দরের বিষয়ে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয় বলে জানান। বিতর্কিত ছাত্র উপদেষ্টাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রধান উপদেষ্টার ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। নির্বাচনের ক্ষেত্রে তিনি ১৬ বছর ধরে সুষ্ঠু ভোটের জন্য জনগণের প্রত্যাশার কথা তুলে ধরে, সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে যৌক্তিক সহযোগিতার অঙ্গীকার করেন।
৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি মজিবুর রহমান মঞ্জুর
বাংলাদেশের পার্টি (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু প্রধান উপদেষ্টার কাছে ৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানান। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, প্রশাসনের পুরো নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতে এলেই তিনি নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করবেন। মঞ্জু জানান, প্রধান উপদেষ্টা আগে পদত্যাগের কথা ভাবছিলেন কারণ সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে তার শঙ্কা ছিল। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমন্বয় বাড়ানো এবং বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব কমানোর গুরুত্ব তুলে ধরেছেন।

প্রধান উপদেষ্টার দৃঢ় সংকল্প ও রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন: প্রেস সচিব
আট দলের বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ার পর দেশের ভেতরে ও বাইরে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে, যা দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে নিশ্চিত করেছেন, দেশের ক্ষতির কোনো কাজ তার অনুমতিতে হবে না। প্রধান উপদেষ্টা সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, যদি সুষ্ঠু নির্বাচন না হয় তবে তিনি নিজেকে অপরাধী মনে করবেন। বৈঠকে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্ব ও সরকারী কাজের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে এবং নির্বাচন ৩০ জুনের মধ্যে সম্পন্ন করার ব্যাপারে সন্তোষ প্রকাশ করেছে।
বৈঠকে আট দলই বিভিন্ন বিষয়ে ভিন্নমত থাকার পরও দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক সংস্কারের লক্ষ্যে একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার করেছেন।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment