×

ঘরে ঢুকে পড়েছে ডেঙ্গু: আগাম পদক্ষেপ না নিলে বড় বিপদ

মৌসুমের আগেই বৃষ্টি শুরু হওয়ায় ফের আতঙ্ক ছড়িয়েছে বাংলাদেশে—ডেঙ্গু ফিরে এসেছে। এবার সময়ের আগে ও আরও তীব্রভাবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০২৫ সালের মে মাসের প্রথম ২৩ দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন অন্তত ১ হাজার ১৯৫ জন। এই সংখ্যা ২০২৪ সালের একই সময়ের তুলনায় ২৩ শতাংশ এবং ২০২৩ সালের তুলনায় ৩৫০ শতাংশ বেশি।  এই পরিসংখ্যান শুধু জনস্বাস্থ্য নয়, নীতিগত প্রশ্নও তোলে—বাংলাদেশে কি ডেঙ্গুকে একটি বাধ্যতামূলকভাবে রিপোর্টযোগ্য রোগ হিসেবে ঘোষণা করা উচিত? জানাচ্ছেন মো. ইসতিয়াক 

আগাম বৃষ্টি, আগাম বিপদ: কেন বাড়ছে সংক্রমণ     

সাধারণত বর্ষায়, জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে, যখন জলাবদ্ধতা ও নালা-নর্দমার অচলাবস্থা মশা জন্ম নেওয়ার জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে। কিন্তু এবার মে মাসের শুরুতে অস্বাভাবিক বৃষ্টি ও উচ্চ তাপমাত্রার কারণে আগেই মশার জীবনচক্র শুরু হয়েছে।  

জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০২৫ সালের মে মাসের প্রথমার্ধে বৃষ্টিপাত ছিল গড়ে ৩৫–৪০ শতাংশ বেশি। এছাড়া তাপমাত্রাও ছিল ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে—যা ডেঙ্গুবাহী এডিস মশার প্রজননের জন্য উপযুক্ত। ‘এটি দেখায় যে ডেঙ্গু আর মৌসুমি রোগ নয় বরং সারাবছরের জনস্বাস্থ্য-সংকটে রূপ নিয়েছে,’ বলেন আইইডিসিআরের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ফারজানা হক।  

জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তারা সতর্ক করেছেন, এই ধারা চলতে থাকলে বাংলাদেশে আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে ২০২২ সালের মারাত্মক প্রাদুর্ভাব, যেখানে ৩ শর বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।  

ডেঙ্গুর ধরন ও জটিলতা

ডেঙ্গু একক নয়, বরং একাধিক রূপে দেখা দেয়। সবচেয়ে সাধারণ হলো ডেঙ্গু জ্বর—যাতে উচ্চ জ্বর, মাথাব্যথা ও শরীর ব্যথা হয়। তবে তা আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বা ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে, যেখানে রক্তপাত শুরু হয় বা রক্তচাপ হঠাৎ কমে গিয়ে জীবনহানির আশঙ্কা দেখা দেয়। 

বাংলাদেশে চারটি ভিন্ন ধরনের ডেঙ্গু ভাইরাস (সেরোটাইপ)—ডিইএনভি-১, ডিইএনভি-২, ডিইএনভি-৩ ও ডিইএনভি-৪—বছরজুড়ে সক্রিয় থাকে। একবার কেউ একটি সেরোটাইপে আক্রান্ত হলে সেটিতে আজীবনের জন্য রোগ প্রতিরোধ হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অন্য সেরোটাইপে আক্রান্ত হলে রোগ বেশ জটিল হয়ে উঠতে পারে।  

ঢাকা মেডিকেল কলেজের গবেষক জহিরুল ইসলাম বলেন, অনেক মৃত্যুর মূল কারণ হলো ভুল নির্ণয় ও দেরিতে হাসপাতালে পাঠানো। ২০২২ সালের মৃত্যুর বেশিরভাগই এই কারণে হয়েছিল বলে জানান তিনি। তাই সময়মতো রোগ শনাক্তকরণ, সচেতনতা ও হাসপাতালের প্রস্তুতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

রিপোর্টযোগ্য রোগ মানে কী 

‘রিপোর্টযোগ্য’ বা ‘ঘোষণাযোগ্য’ রোগ হলো এমন রোগ, যা শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইন অনুযায়ী স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে জানানো বাধ্যতামূলক। এতে সরকার ‘রিয়েল-টাইমে’ রোগের বিস্তার বুঝতে পারে, দ্রুত চিকিৎসাব্যবস্থা নিতে পারে এবং এলাকাভিত্তিক মশা নিয়ন্ত্রণ বা জনসচেতনতা কার্যক্রম চালাতে পারে।

বাংলাদেশে বর্তমানে যক্ষ্মা, কলেরা, পোলিও ও হাম এই তালিকায় রয়েছে। তবে ডেঙ্গু এখনো এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ফলে বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো অনেক সময় ডেঙ্গু রোগীর তথ্য রিপোর্ট করে না, যার ফলে প্রকৃত পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না এবং সরকারের পদক্ষেপ নিতে দেরি হয়।

সংক্রামক রোগ আইন, ২০১৮ অনুযায়ী, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চাইলে আইইডিসিআর ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরামর্শ নিয়ে গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে যেকোনো রোগকে রিপোর্টযোগ্য ঘোষণা করতে পারে। একবার ডেঙ্গু এ তালিকায় এলে, সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালের জন্য তা রিপোর্ট করা বাধ্যতামূলক হবে, যা একটি সমন্বিত জাতীয় তথ্যভাণ্ডার গঠনে সহায়তা করবে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি ডেঙ্গুকে রিপোর্টযোগ্য রোগ হিসেবে ঘোষণা করা হয়, তাহলে একদিকে যেমন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, অন্যদিকে দেশের সকল স্তরে সচেতনতা, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থাও অনেক বেশি কার্যকর হবে। 

সরকার কী বলছে 

সরকার ২০২৪ ও ২০২৫ সালে ডেঙ্গু মোকাবিলায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ শহর যেমন ঢাকা ও চট্টগ্রামে ফগিং ও লার্ভানাশক ছিটানোর জন্য বরাদ্দ বাড়ানো, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-ভিত্তিক হটস্পট চিহ্নিতকরণব্যবস্থা চালু, মসজিদ, স্কুল ও টেলিভিশনের মাধ্যমে জনসচেতনতা প্রচারণা, সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ড বাড়ানো ও বস্তি এলাকায় মোবাইল চিকিৎসা ইউনিট চালু করা।  

তবে ব্র্যাক হেলথের মহাপরিচালক আমিনুল হক বলেন, এই পদক্ষেপগুলো মূলত প্রতিক্রিয়াশীল, প্রতিরোধমূলক নয়। ডেঙ্গুকে রিপোর্টযোগ্য ঘোষণা না করলে কর্তৃপক্ষ বরং সব সময় পিছিয়ে পড়ছে, যা দেশে ডেঙ্গু মোকাবিলার বড় ফাঁকফোকরের সৃষ্টি করছে।

নগর জীবনে ডেঙ্গুর বিস্তার

ডেঙ্গু শুধু স্বাস্থ্য সমস্যা নয়—এটি নগর ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি। গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার প্রায় ৯০% এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায় ঘরের ভেতর—ফুলের টব, ছাদের পানির ট্যাংক, নির্মাণসামগ্রী রাখার পাত্র ইত্যাদিতে।

নগর স্বাস্থ্যনীতি গবেষক তাহমিনা আলী বলেন, ‘আমরা এক নগর-রোগকে মোকাবিলা করছি গ্রামীণ পদ্ধতিতে।’ 

প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এখনই সময় একটি সমন্বিত জাতীয় ডেঙ্গু প্রতিরোধ কৌশল গ্রহণের। তাঁদের মতে, প্রথমেই ডেঙ্গুকে ‘রিপোর্টযোগ্য’ রোগ হিসেবে ঘোষণা করা জরুরি, যাতে সরকারি ও বেসরকারি সব হাসপাতাল বাধ্যতামূলকভাবে রোগীর তথ্য সরকারের কাছে জানায়। এতে করে ডেঙ্গুর প্রকোপ সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে এবং দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে। 

দ্বিতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ডেঙ্গু এখন যেকোনো সময় ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই শুধু বর্ষাকাল নয় বরং বছরজুড়ে নজরদারি ও মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম চালু রাখতে হবে। তৃতীয়ত, নগর এলাকায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থাপনায়ও বড় ধরনের সংস্কার দরকার—সিটি কর্পোরেশন ও স্থানীয় বাসিন্দাদের যৌথভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও জলাবদ্ধতা দূর করতে হবে।    

সবশেষে একটি সমন্বিত স্বাস্থ্য তথ্য ড্যাশবোর্ড চালু করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। যেখানে সরকারি ও বেসরকারি উভয় প্রতিষ্ঠানের তথ্য একত্রে বিশ্লেষণ করে ডেঙ্গু সম্পর্কে আগেভাগেই সতর্ক সংকেত দেওয়া যাবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই চারটি উদ্যোগ আমাদের ডেঙ্গু মোকাবিলায় শুধু তাৎক্ষণিক সমাধান নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরোধের পথ দেখাতে পারে। 

গত কয়েক বছরের তথ্য থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশ আর ডেঙ্গুকে কেবল মৌসুমি সমস্যা হিসেবে দেখতে পারে না। আগাম বর্ষা, বাড়তে থাকা তাপমাত্রা এবং দ্রুত বর্ধমান শহরগুলো ডেঙ্গুকে বড় জনস্বাস্থ্য-সংকটে পরিণত করেছে। দরজা জানালা বন্ধ করেও আর লাভ নেই। ডেঙ্গু ইতিমধ্যে আপনার ঘরে ঢুকে গেছে। যার সমাধান প্রয়োজন আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংস্কৃতিক স্তরে।   

এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:

Post Comment